“চোখের আলোয় দেখেছিলেম”
“চোখের আলোয় দেখেছিলেম”
- Dip Saha Chowdhury
[ রোদ্দুর
]
শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশা
মাখা এই শহরের বিকেলের ভেজা কাঁচ তখনও জানান দিচ্ছে যে অনুপম রায়ের সেই বিখ্যাত
গান,”বসন্ত এসে গেছে” শোনার দিন এখনও আসে নি। ব্যালকনির ভেজা কাঁচের ঠেলা সরিয়ে
কফি হাতে বাইরে এসে দাঁড়ালো রাগিনী। গরম কফির ধোঁয়া তখন তার চুলের উষ্ণতাকে
সামান্য প্রভাবিত করতে পেরে নিজেকে আপ্লুত করছে। হঠাত প্যান্টের পকেটে সেলফোনটা
বিপ করে উঠলো। চটপট বের করে আনলো। ফেসবুক থেকে একটা নতুন নোটিফিকেশন এসেছে, যার
অর্থ হলো, ইমন তার শহরে পা রেখেছে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না রাগিনী। কফি-মগটা টেবিলে
রেখে চেঞ্জ করে নেয় সে। ইমনের খুব পছন্দের লাল পাড়ের শাড়িটা পড়েছে সে। কানের দুলটা
লাগাতে লাগাতেই বেজে ওঠে ডোরবেলটা।
ডোরবেলটা দিনে অন্তত ৫-৬
বার বাজে কিন্তু আজ অবশ্য কারণটা অন্য। একটা মিনি ‘পাকা দেখা’। ওদের সম্পর্কের কথা
কয়েকদিন হলো বাবাকে জানিয়েছে রাগিনী। ওদের সম্পর্কটাকে অন্যভাবে জানতেন ওর বাবা
কিন্তু যখন রাগিনী তাকে এটা জানায় যে সে তাকে ভালোবাসে, তখন কিন্তু ঋতমবাবু রাগ
করেন নি। এর কারন হয়তো এটাই যে বাবা-মা সবই জানেন, বুঝতে পারেন। শুধু এটাই বলেন
যে, “মাকে এখন জানাস না। আমি মুড দেখে জানাবো। নাহলে তো আরকি...”। ইমনকে বাড়িতে
আসতে ঋতমবাবুই ফোন করে জানিয়েছিলেন। এমন একটা দিনে জানিয়েছিলেন যেদিন তার বৌ বাড়ি
নেই। সঙ্গে অবশ্য তার খুড়তুতো ভাইও থাকবে। সে 2nd
ইয়ারের ছাত্র। তার ইমনকে দেখার খুব আগ্রহ ,
কারন সে সারাদিন ভাবে এতো ভালো একটা মানুষ এতো ভালো কি হতে পারে। ঋতমবাবু নিজেই
দরজা খুললেন। বললেন ভেতরে এসো। ততক্ষণে সোফায় এসে বসেছে রাগিনী। শান্তভাবে টেবিলের
এককোনায় একটা সোফায় এসে বসলো সে। মুখে একটা স্নায়ুবিক চাপের ছাপ স্পষ্ট। আস্তে করে
দরজাটা বন্ধ করলেন ঋতমবাবু কিন্তু সেই সামান্য আওয়াজেই যেন কেঁপে উঠলো ইমন। ঠিক যেন
ইন্টারভিউ দিতে এসেছে সে।সেটা দেখে একটু মুচকি হাসলো রাগিনী। আশার পর থেকে তার ভাই
পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করলো। ইমনের চোখে চোখ পরতেই ইমন একটা ক্যাবলা হাসি
দিলো। মানে টেনশনে সব গুলিয়ে গেলে যা হয় আরকি। ঋতমবাবু অবস্থা দেখে ইমনকে বলল, “তুমি
ঠিক আছো?”। ইমন সামান্য ইতঃস্ততঃ হয়ে বলল, “হ্যাঁ কাকু...”। তিনি রাগিনীকে বললেন
জলখাবারের ব্যাবস্থা করতে বললেন। রাগিনী চলে যেতেই কাকু বললেন,
“দেখো, তোমার ভয় পাওয়ার
কোনো কারন নেই। এমন কিছু একটা হতে পারে তা আমি আগেই জানতাম। আর এটা খারাপ কোনো পদক্ষেপ
তাও আমি মনে করি না। আমার তোমাদের উপর বিশ্বাস করি। শুধু ওর মাকে ম্যানেজ করতে হবে,
তাও চিন্তার কারন নেই। দায়িত্বটা আমিই নিয়েছি। আচ্ছা পরিচয় করে দিই ও হলো রিহান। আমার
ভাইয়ের ছেলে। ও কলেজে পড়ছে।” ইমন রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, হাই!!, কেমন আছো? রিহান
হাতের ফোনটা রেখে বললো, ভালো, তুমি?
- ভালো।
এর মধ্যে রাগিনী জলখাবার
নিয়ে সামনে রাখলো। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বুঝলো যে সত্যিই তার রাগিনী ভালো কফি বানাতে
পারে তা আজ স্বীকৃতি পেলো। কিছুক্ষণ পর ঋতমবাবু গলা খ্যাঁকরানি দিয়ে বলল,
- তা কথাবার্তা শুরু করা যাক? আসলে সবাই যখন আছে।
পাশে রাখা জলের গ্লাসটা থেকে
জল খেয়ে ইমন বলল,
- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
- তা তোমার কিছু চাহিদা কিছু আছে কি?
উত্তরটা সবার জানাই ছিলো,
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইমন বলল,
- হ্যাঁ আছে। অবশ্যই আছে।
সামান্য নড়েচড়ে বসলো সবাই,
রাগিনীর চোখে তখন বিস্ময়ের ভাব স্পষ্ট।রিহানের চোখে একটা অবজ্ঞার ভাব ফুটছে। ঋতমবাবু
বললেন,
- হ্যাঁ বাবা তো বলো কি চাই তোমার?
- একটা শর্ত আর একটা জিনিস।
উত্তেজনার পারদ তখন মধ্যাকর্ষনের
বিরুদ্ধে উপরে উঠেই যাচ্ছে। ঋতমবাবু উত্তেজনার সুরে বললেন
- কী শর্ত?
- রাগিনীকে চাকরী করতে হবে।
- চাকরী!!! কেন?
- দেখুন বিয়ের পর আমাদের মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হবে এটাই
স্বাভাবিক। তখন যেন এটা ওর কখনো মনে না হয় যে ও পরাধীন। ও নির্ভরশীল। নিজেকে ছোটো
না মনে হয়। ও যেকোনো সম্মানজনক চাকুরী করুক তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ও
যেন করে। ও চাকরী না করলে আমি অ্যাক্সেপ্ট করতে পারবো না। সব মেয়েরা বলে ‘আমি অপেক্ষা
করতে রাজি’ আজ আমি বলছি, ‘আমি অপেক্ষা করতে রাজি’।
সন্তুষ্টির হাসি মুখে
নিয়ে ঋতমবাবু প্রশ্ন করলেন,
- আর জিনিসটা?
- হুম জিনিসটা হলো, রাগিনীর ঘরে যে রঙটা আছে তার Colour Code টা।
অবাক হওয়াটা যেন অভ্যাস
হয়ে যাচ্ছে। সেই অবাক চোখে রিহান জিজ্ঞাসা করলো, - সেটা কেন?
- ঐ রংটাই আমি আমদের ঘরে করবো, যাতে এটা তার কখনোই মনে না হয়
যে সে অন্য কোনো বাড়িতে আছে। যেন মনে হয় সে সেই বাড়িতেই আছে।
ভেজা চোখে সোফার পাশটা খামচে
ধরে রাগিণী। যতবারই তার মনে হয়েছে পৃথিবীতে কুৎসিত বলেও একটা জিনিস আছে এই ছেলেটা
প্রমান করেছে যে সে কতোটা ভুল। এরপর অবশ্য
অনেক কথোপকথন হলো সেগুলো জাস্ট এই ভালো লাগার অবস্থায় বারতি।
ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা, উঠে
পড়ে ইমন। সবার কাছে বিদায় নেওয়ার সময় কানে কানে রিহানকে বলে, “বইয়ের কভারে বইয়ের চরিত্র
লেখা থাকে না, লেখা থাকে শেষ পাতাশকে” বাইরের রাস্তা তখন ফাঁকা। রাস্তায় ইমনকে এগিয়ে
দিতে আসে রাগিনী। ইমন ফিসফিস করে বলে, “ইন্টারভিউ কেমন হল?”। রাগিনী চোখের দিকে
তাকিয়ে বলল, “চোখের আলোয় দেখেছিলেম আমার মনের মানুষকে”। ইমন শুধু একটা লাইন যোগ
করলো, “ঠোঁটের কোনা ভিজিয়ে দিয়ো ঠোঁটের ছোঁয়াতে।”
নিজের ঠোঁটটা কামরে ধরে
রাগিনী চোখে তখন জেগে উঠেছে একফালি দুষ্টুমি। কলারের খোলা অংশটা ধরে ইমনকে ধরে
তাকে নিয়ে যায় অন্ধকার এক কোনায়।
থাক, আর জানতে হবে না। এই
ভেবে শীতের শীতলতায় উত্তাপ দেবেন না। তাদের ছেড়ে আপনার মনের অন্তরালে।
ভালো থাকবেন। আগামী বছরের
শুভেচ্ছা রইলো।
Comments
Post a Comment