রেড-লাইট
- Dip Saha Chowdhury
(#রোদ্দুর)
২৭/০৫/২০১৮ –
বিগত ২১ বছর এই সাংবাদিকতার জীবনে অনেক ঘটনাই দুই চোখ চাক্ষুস করেছে।২১ বছরে
গ্রীনিচের বিগবেনের কাঁটা যেমন থামেনি একমুহুর্তের জন্য তেমন থামেনি আমার কলমের
ভাবনা। আজ যে গল্পটা লিখতে চলেছি তা হয়তো কোনো দঃসাহসিক কৃতকর্ম না, তবে লেখার
দাবি রাখে। অন্তত আমার ৫০০ টাকার পার্কার পেনটির তাই মত। কথায় বলে ভগবানের সবচেয়ে
সুন্দর আবিস্কার হলো মানুষ কিন্তু আসল কথাটি হল, মহাজগতের সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি
হল নারী। আর কুৎসিততম ব্যাবসা হল দেহব্যাবসা। কারন পৃথিবীর আদিমতম ঋপু হল – “কাম”।
আমার কর্মজীবনটা বেশ
গতিশীল। প্রথমে একটা ছোট্টো খবরের কাগজের অফিসে কাজ করতাম। হেয়ারস্ট্রিটে ছিলো
রিপোর্টার অফিস। ২ বছর কাজ করি সেখানে তারপর ডাক আসে ৬, প্রফুল্লচন্দ্র স্ট্রিট
থেকে, অফিসের চেনা নামটা আর বললাম না। সেখানে ১৫ বছর কাজ করে অফিস বদলাই। এবার
ঠিকানা হয় সেক্টর ফাইভ।
ওরকম শান্ত পরিবেশে কাজ
করতে খারাপ লাগতো না। ভালো না লাগলে ফাঁকা রাস্তাটাই ছিলো সম্বল কিন্তু এটাও
স্থায়ী হলো না। চিঠি এলো সমুদ্রপার থেকে অর্থাৎ Midtown
Manhattan, NY থেকে কিন্তু তারা একটা
শর্ত রেখেছে, “They Need A Dark Story of
India”। তো অনেক ভাবলাম কি লেখা যায়, কি বিষয়, কিন্তু
মাথায় এলো না কিছুই। হঠাত, চোখে পড়লো খবরের কাগজ। বড় বড় করে লেখা “যৌনপল্লিতে
রহস্যমৃত্য”। ব্যাস আর দেখে কে, এক বন্ধুকে ফোন করলাম যাতে সে কোনো এক যৌনকর্মীর
সাথে একটা কথা বলার ব্যাবস্থা করে দিতে পারে। বিকালে ফোন এলো যে ব্যাবস্থা হয়ে
গেছে, ২৬ তারিখ, সকাল ১১ টা, পরের একটা দিন লেগে গেলো মাথার মধ্যে প্রশ্ন সাজাতে
সাজাতে। আর কিছু পুরানো ভয় জাঁকিয়ে ধরলো আমায়।
সেক্টর ফাইভ থেকে
পার্সোনাল গাড়িতে উঠলাম সঙ্গে সেই বন্ধুটি, সে ছবি তুলবে বলেছে।
রবিবারের কর্মভিড়হীন
রাস্তায় ছুটে চললো, সকালের রোদ এসি গাড়ির কাঁচ ভেদ করে বুকপকেটের পেনের উপর পড়লো,
একটা মিষ্টি আলো এসে গাড়ির ছাদে খেলা করতে লাগলো। যখন যৌন পল্লিতে গাড়ি প্রবেশ
করলো বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। সেই ১৯ বছর বয়েসের কথা। প্রথম প্রেমে
প্রত্যাখাত হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরমধ্যে কিছু খারাপ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মদ,
গাঁজা সব কিছুতেই নাম লিখিয়েছিলাম আমি। একরাতে হয়তো সে নেশাও কম হয়ে গেছিলো।
বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এসে পড়েছিলাম এই লালসার নরকে। যেখানে প্রেম , ভালোবাসা বলে
কিছু হয়না, অনুভূতি বলে কিছু হয়না। শুধু হয় যৌনতার কামনা। সেই রাতে বাড়ি ফেরা হয়নি
আমার। বাড়ির লোক খবর পেয়ে নিয়ে জায় পরেরদিন। তারপর দুবছর রিহ্যাবে নিজেকে একটু
একটু করে ভেঙ্গেছি। পরিবারের টাকা ছিলো তাই জীবনের স্রোতে ফিরেছিলাম নাহলে হয়তো
কেউ আজ ম্যানহ্যাটেনে হাঁটার স্বপ্ন দেখাতে পারতো না। একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম
যে সেই যে অবস্থাতে দেখেগেছিলাম, আজও সেই অবস্থাতেই আছে সব, সেই ছোটো ছোটো ঘর, নীল
দেওয়াল, ঘরের সামনে ছোটো নর্দমা। স্যাতস্যতে এই আবহাওয়ার একটা আলাদা গল্প আছে,
লালসার গল্প। এক মোটা করে মহিলা দেখলাম সামনে টেবিল নিয়ে বসে পান চিবোচ্ছে। একটু
উঁচু গলায় বলল, “কয়্যা... বাবুয়া... সুবা সুবা চালে আয়ে হো। রাহা না গ্যায়া ক্যা।
আরে হামে ভি তো সোনে দো।” পাশ থেকে আমার বন্ধু ঋক বলে উঠলো, “আরে না মাসি.. ইনি
রিপোর্টার আছেন, ঐ কিছু লিখবেন তাই এসেছেন।” ঐ মহিলা বললেন, “ক্যায়া মিলতা হ্যাঁ
ইয়ে কারকে?? দুনিয়াকে সামনে ক্যায়া দিখাতে হো... কি হামারে লিয়ে প্যার , দুখ...
হ্যাঁ?? না বাবুয়া না ... তুম লোগ হামকো- হামারে কাহানিওকো বেচতে হো... ঠিক এক ওর
বার ভি বেচ দো। এ পূলি যারা সতি কো বুলানা আউর তিন কুসসি দেনা বাবুওকো।” বলে উঠে
গেলেন ঐ মাসি... যেতে যেতে বিড়বিড় করে গেলেন, “শালা... শারিফ বানতা হ্যাঁ...
ব্যাহেনচো**... আরে তেরে হি ব্যাহেন-ভাবি হ্যাঁ শালা... শালে বেচ দেতে হো ফির
কাহানিয়া লিখতে হো...” একঘটি জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করতে ভিতরে চলে গেলেন। মনে শুধু
একটা প্রশ্ন-কৌতুক উঁকি দিলো নাম নাকি সতী... আরো অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো হঠাত
একজন এসে বলল, “নমস্কার... আমি সতী...”
লালচে গোলাপী শাড়ি পড়া এক
মহিলা সামনে এসে দাড়িয়েছেন। মুখের দিকে তাকিয়ে আমার না সব হিসেবকেমন গুলিয়ে গেল...
সত্যি মুখের মধ্যে একটা দেবীর আদল পেলাম। ততক্ষণে চেয়ার এসে গেছে, উনি শান্ত গলায়
বললেন বসুন। চেয়ারটা টেনে বসলাম। একজন বাচ্চা মেয়ে ২ গ্লাস সরবত দিয়ে গেল। মহিলাটি
বললেন, “যা বলবেন একটু তাড়াতাড়ি আসলে আমরা তো কাজের মানুষ, বসলে পেট চলবে না।”
তো আমি খাতা-কলম বের
করলাম , ঋক একটা ফটো তুলে নিলো। আমি প্রশ্ন-উত্তর শুরু করলাম,
- নমস্কার আমি, ঋষি দাশগুপ্ত
- আমি সতী, পদবিটা না হয় থাক, ওটা বড্ড বেমানান। ওটা মায়া জোগায়,
মায়া... হ্যাঁ তো এগিয়ে চলুন।
- পদবিটা মায়া জোগায় কেন?
- আরে বাহ রে, ওটা যে পরিবারকে মনে করায়। আমাদের যে পরিবার
থাকতে নেই। সেই কবে পাড়ার একজনের সাথে প্রেম হয়েছিলো। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলাম
তাই তাদের মুখ আর দেখিনি কখনো। ১ বছর সংসারও করি। ১৭ বছর বয়েসে সংসার কি বুঝতে
বুঝতেই একদিন মদের নেশায় বড় এসে বেঁচে দিলো এখানে। এখন তো আমার রোজ রাতে সংসার হয়
আবার ভেঙে যায়। মায়া রাখতে নেই যে আমাদের।
- বাড়িতে কে কে আছে?
- বাড়ি [ একটা দীর্ঘশ্বাস নামলো লিপস্টিক মাখা ঠোঁট ছুঁয়ে]...
হ্যাঁ বাবা-মা-এক ভাই। কেউ তো খোঁজ রাখেনি, তবু ভাই মাঝে মাঝে রাতে ফোন করে ও
আমাকে খুব ভালোবাসে যে। ও বলেছে কেউ যদি বলে বাড়িতে আর কারও নাম বলতে হবে না। কিন্তু
ভাইয়ের নাম অবশ্যই বলবি, আমি তো তোরই ভাই। তুই যেমনই হোস। ওর নাম দীপ। প্রতি
ভাইফোঁটাতে ও আমায় এসে চকলেট দিয়ে যায়। ভালো লাগে এটা জেনে যে কেউ পাশে আছে। ওকে
আমি সব বলি। ভালো-মন্দ সব।
- কখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না?
- কোথায় যাবো?? আপনাদের সমাজে? যেখানে একটু বেচাল দেখলেই
“বেশ্যা” নাম দেয়। ধর্ষণ করে যৌনাঙ্গে রড ঢুকায়?? বাড়ির বৌকে মদের নেশায় বেচে দেয়।
কে বলেছে ক্রীতদাস প্রথা উঠে গেছে?? এটা ক্রীতদাসের সাম্রাজ্য... অন্তত এখানে
আমদের রড ঢুকানো হয় না। দামিনী হতে হয়না আমাদের। দামিনী মারা গেলে কি করেছিলেন তার
নামে আইন বের করলেন কেন জানেন? যাতে প্রতিবার এটা মনে পড়ে সংবিধানের পাতায় যে
সেদিন কিছু শিয়াল সফল স্বীকার করেছিলো।
আরও কিছু বলতে
যাচ্ছিলো, হঠাত TOI এর এডিটর ফোন করলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “What
Are You Doing Man?”
আমি আমতা আমতা
করে বললাম, “Actually Sir… I’m Writing a
story… on.. on…”
পাশ থেকে উত্তর
এলো, “You’re Making A Story on
Harlots” কথাটা শুনে ফোনটা কোনো মতে সামলালাম। তারপর
অল্পভাষণে ফোন কেটে মহিলাটির উপর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম, মহিলাটি মুচকি হেসে
বলল,
“আমি English এর উপর MA করেছি, সাথে Experimental Psychology তে ডিপ্লোমা। আমার পড়ার ইচ্ছে ছিলো। ওপেন ইউনিভার্সিটিতে সপ্তাহে দুদিন ক্লাস
করতাম... এটুকু বোঝাতে যে বেশ্যা মানে মুর্খ নয়।”
নিজেকে সামলে
আবার প্রশ্ন করলাম,
- আপনাদের জীবনে প্রেম আসে না??
একটু জোরে হেসে
সে বলল,
- প্রেম... সে তো আসে রোজ রাতে, বীর্যে মাখা হয় চাঁদর, আবার
কামনা মিটে গেলে জাতির-জনকের ছবিতে প্রেম বেচে দি। আমাদের ঋতু আছে, ঋতুচক্র আছে,
শুধু বসন্ত নেই। ঐ যে মেয়েটাকে দেখছেন, জ্বর হয়েছিলো। তো হস্পিটালে নিয়ে গেছিলাম।
৩ দিন ভর্তি ছিলো। তো সেখানে এক ডাক্তারকে পছন্দ হয়। কথা হতো, তারপর একদিন নিজের
কোয়ার্টারে নিয়ে চরম সেবা করলেন... আর তারপর আর ফোন ধরেনি। আমরা একটা মাংসপিন্ড,
নিজেদের প্রেমে ধোঁকা খেলে আমাদের এসে পিষে যান... আমরা মানুষ নই, হতেও চাইনা
আপনাদের ঐ মনুষত্ব পকেটেই রাখুন। আপনারা সব ভদ্র মানুষ। “Behind The Mask Everyone is a Pervert”। থাক আজ এপর্যন্তই। রান্না-খাওয়া-স্নান বাকি। আমাদের আবার
কাস্টমার আসবে। তাছাড়া আমি এখানে একটা স্কুল চালাই। শিক্ষা দিই, মানুষ হওয়ার নয়,
মানুষ পোষার। ভালো থাকবেন। আবার রেডলাইটে দেখা হবে।
কথাটা আমার কানে
বাজতে থাকলো, “নিজেদের প্রেমে ধোঁকা খেলে আমাদের এসে পিষে যান..”
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে
থেকে গাড়িতে উঠলাম। বাইরে তখন ঝড়ের পূর্বাভাস। স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা আমায় জাঁকিয়ে
ধরলো। গাড়িতে উঠে ল্যাপটপতে হেডলাইন লিখলাম- Harlot
Story. তারপর কেটে আবার লিখলাম- [Her-Lot-Story].
- Dip Saha Chowdhury
Comments
Post a Comment