পিরিয়ডস ( পর্ব- ২ )
পিরিয়ডস
পর্ব- ২
-
Dip Saha
Chowdhury
শিস বাজাতে
বাজাতে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি, দেখলাম দূরে একটা কুকুর তার বাচ্চাকে
দুধ খাওয়াচ্ছে। আমার পায়ের শব্দ শুনতেই আরও যেন জুবুথুবু হয়ে নিজের বাচ্চাটাকে
ঘিরে ধরলো। যেন কোনো অজানা আঘাত থেকে বাচ্চাকে বাঁচাতে চায় মা। সন্তানের সামান্য
আঘাতটুকুও সহ্য করতে পারবে না সে। কিন্তু তাতে বাচ্চাটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে
আপন মনে মায়ের স্নেহটুকু গ্রহন করে চলেছে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় তার চোখটা হালকা
জ্বলজ্বল করে উঠলো। বাড়ির সিঁড়িতে পা দিতেই পকেটের সেলফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো।
ফোনের সেফ লকটা খুলতেই আমার মুখের ওপর সাদা আলোটা এসে পড়লো। একটা এসএমএস এসেছে।
রাগিনীর... মনের আবেগগুলো যেন সব বুকের ঠিক মাঝখানটায় এসে জমাট বাঁধল। এসএমএসে
লেখা আছেঃ
“জানিস তো ভালোবাসা এই ,
ভালোবাসা ঐ, এটা বলটা না খুব সহজ। কিন্তু যেটা বলা যায়। যা কোনোদিনও শব্দে
ব্যাখ্যা করা যায় না সেটা তুই করে দেখালি, পাশে থেকে দেখালি সেই দিনগুলিতে যা হয়তো
ছেলেরা অনুভব করবে না। কোনোদিন। পেইনকিলার হয়তো ব্যাথা কমাতে পারে কিন্তু ব্যাথা
সহ্য করার আশকারা দেয় না। আমার সব আবদার তুই মেনে নিস। সেরকম না বলা কথাগুলিও যেন
বুঝে যাস। হয়তো তোর মতো কোনোদিন ভালবাসতে পারবো না তোকে। কিন্তু কমটিও বাসি না
যেনে নিস। ভালোবাসি... ”
আমি কি বলবো জানি না। তাও
কাঁপাকাঁপা হাতে ম্যাসেজটা টাইপ করলাম... “খুব ভালোবাসি পাগলী... ঘুমিয়ে পড়... Good Night…”। হয়তো আবেগগুলি
সবসময় ম্যাসেজে বোঝানো যায় না। শব্দের বাইরেও এক জগত আছে। যেখানে শব্দের প্রবেশ
সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।
ডোরনবটা ঘুরিয়ে যখন ঘরের
দরজাটা খুললাম, একটা জমাট বাঁধা গুমোট হাওয়া মুখের পাশ ছুঁয়ে বিদায় জানালো। ক্যাঁচ
করে দরজাটা খুলতেই অন্ধকারে সুইচবোর্ডের লাল আলোটা যেন সাদা জামায় এসে পড়লো। সেই
দিকে হাত বাড়িয়ে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলাম। নিকশ কালো অন্ধকার যেন একমুহুর্তে
হ্যারি পটারেরের ম্যাজিকস্পেলে[Lumos] আলোকিত হয়ে গেল। জুতো-জামা খুলে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালাম।
বাথরুম থেকে যখন ঘরে ঢুকলাম তখন মাথার চুল ছুঁয়ে জল টপটপ করে ফ্লোরে এসে পড়ছে।
তারতারি করে টাওয়ালটা নিয়ে মাথা মুছে, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
আজও সেইদিনটার কথা মনে
পড়ে। ক্লাস ইলেভেনের এক সকালে English
Literature এর ক্লাস চলছে। পাশেই
বসেছিলি তুই। হঠাত দেখলাম একটু দূরে সরে বসলি। আমি ব্ল্যাকবোর্ডটা কপি করতে করতে
বললাম কি হলো। তুই মুখ লুকিয়ে বলেছিলি কিছু না। তারপর আস্তে আস্তে দেখলাম তোর
মুখটা কেমন যেন হয়ে উঠেছে। মুখ কেমন যেন লাল হয়ে উঠেছে। বললাম কি হয়েছে। তুই খুব
রাগ দেখালি। কিন্তু আমি তোর মুখে সেদিন কোনো রাগ খুঁজে পায়নি একটা চাপা কষ্ট দেখতে
পেয়েছিলাম। তোর পায়ের দিকে দেখতেই আমার সব প্রশ্ন যেন চিন্তায় পরিনত হল, দেখলাম পা
দুটো জোড়া করে বসেছিস। খুব কষ্টে কিছু একটা চেপে রেখেছিস। স্কার্টের নিচের দিকে
একটা লালচে ছোপ। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। কাঁদতে
চেয়েও কাঁদতে না পারলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনটা। ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যাডাম একটু ক্লাস
থেকে বেরোতেই আমি তোকে লুকিয়ে আস্তে আস্তে ক্লাসের বাইরে বের করে আনলাম। কে কতোটা
দেখেছিলো আমি জানিনা, জানতে চাইও নি সেই দিন। ক্লাসের পিছনে ফাঁকা ঘরটায় নিয়ে
বসিয়েছিলাম। নিয়ে আশার পথেই দেখেছিলাম যে তোর সাদা স্কার্টটা ধিরে ধিরে লাল হয়ে
যাচ্ছে। খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো নিজেকে। কেন জানিনা মনে হচ্ছিলো একটু একটু করে হেরে
যাচ্ছি আমি। তোকে আগলে রাখার দায়িত্ব থেকে। বসিয়ে দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম
-
প্যাড এনেছিস।
তুই আর কান্না ধরে রাখতে
না পেরে হাউহাউ করে কেঁদে আমার জামার আস্তিনটা ধরে বলেছিলি।
-
আমি ভুলে গেছি। আমি সব ভুলে গেছি ইমন। তুই শুনছিস, আমি সব ভুলে গেছি।
আমি তোর মুখটা
দুহাতে চেপে ধরে বলেছিলাম,
-
আমি যখন আছি,
কখনো কিচ্ছু হবে না।
তুই হাতটা
বাচ্চাদের মতো চেপে ধরেছিলি। যেন কোনো বাচ্চা রাস্তা পার হতে ভয় পাচ্ছে কিন্তু
ভরসা আছে যে যার হাত ধরে পার হবে সে ঠিক পৌঁছে দেবে।
তারপর আমি আস্তে আস্তে
তোকে তুলে নিয়ে টয়লেটে বসিয়ে দিলাম। বললাম তুই চিন্তা করিস না। আমি আসছি। যতক্ষণ
না আসব অপেক্ষা করিস। তুই শুধু দরজার ওপাশ থেকে বলেছি “হুম... তারাতারি আসিস...”।
এরপর শুরু হল আমার যুদ্ধ।
স্কুলের পিছনের পাঁচিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। অপেক্ষাকৃত কম উঁচু। এখান থেকে কাঁটাতারটাও
অনেকটা ফাঁকা। পাঁচিল দিয়ে উঠে আস্তে আস্তে নামলাম। চোট তেমন কিছু লাগে নি। লুকিয়ে
লুকিয়ে সামনের বড়ো রাস্তায় পা রাখলাম। কিন্তু আশেপাশে তেমন মেডিসিন শপ নেই। তাই
অনেকটা হাঁটতে হল। প্রায় ১০ মিনিটে হেঁটে একটা দোকান চোখে পড়লো। দোকানটায় একটু ভিড়
ছিলো। কি করবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। নিজের মধ্যে একটা দ্বন্ধ চলছিলো। কিন্তু রাগিনীর
অবস্থাটা চোখে ভাসতেই যেন সব দ্বন্ধ মিলিয়ে গেলো। যেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসে
কুরুক্ষেত্রকেই লন্ডভণ্ড করে দিয়েছেন। এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে, একটু শান্ত গলায়
বললাম, “দাদা... একটা প্যাড দেবেন।” লোকটি চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ...
কি?”। আমি খনিকটা বিরক্তির স্বরে বললাম, “স্যানিটারি প্যাড...”। উনি আর কিছু বলেন
নি, প্যাডের দামটা চুকিয়ে যখন ফিরছি তখন আড়চোখে দেখলাম কাস্টোমার দের মধ্যে একটা
কানাঘুষো শুরু হয়েছে। মনে মনে বললাম... “আরে ওটাতো বদ্ধ মানুষদের কারাগারের
উল্লাস...”। ঘড়িতে যখন চোখ পড়লো ২০ মিনিট হয়ে গেছে। আমি রাস্তা দিয়ে দৌড় দিলাম।
তারাতারি পৌছাতে হবে। হঠাত খেয়াল করিনি। একটা অটো এসে ব্রেক করতে করতে ধাক্কা
মারলো বাঁ হাতটায়। তেমন কিছু হয়নি তখন। ঘড়িটা শুধু কোঠায় পড়েছে জানতে পারিনি কখনো।
উঠে পড়ে আবার দৌড়েছিলাম। ১০ মিনিটের রাস্তা এসেছি সাড়ে ৫ মিনিটেরও কম সময়ে। সেই
ছোটো দেওয়ালটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্যাডের পাউচটা আগেই ছুঁড়ে মারলাম। দেরি হয়ে
গেছে অনেকটা তাই হুড়মুড় করে উঠতে গিয়ে কাটাতারের একটা কোনা আমার হাতের শিরা বরাবর
চিরে দিলো অনেকটা। সবকষ্টের ইতিহাস মাথাচারা দিয়ে কবরখুড়ে যেন কিছুর হিসাব নিতে
এসেছে তারা। ঐ পাশে যখন নামলাম গলগল করে উঠেছে রক্ত। হাতের রেখা দিয়ে নেমে আসছে
তারা। তাড়াতাড়ি টয়লেটের কাছে গিয়ে নক করলাম, আছিস। তুই বললি “এই তো... এতো দেরি
হলো...” আমি বলেছিলাম “দোকানে একটু ভিড় ছিলো”। বাকিটুকু ব্যাক্তিগতই থাক। পাউচটা
দেওয়ার সময় দেখলাম তাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। নিজের প্যান্টে ওটা মুছে নিলাম।
রাস্তায় আসতে আসতে একটা বুথ থেকে কাকিমাকে ফোন করে দিয়েছিলাম। দেখলাম তিনিও এসে
গেছেন। “আমি বললাম কাকিমা এসে গেছে, আড় একটা সেট জামাকাপড়ও আনতে বলেছিলাম। আমি
ক্লাসে যাই...” তুই দরজা খুলে ছলছলে চোখে বলেছিলি “তোর মতো কেউ নেই... আজ তোর
মধ্যে মাকেও পেয়ে গেলাম। যা...” বাথরুমের পাশে দাঁড়িয়ে রুমালটা বের করে এনে হাতের
জায়গাটা বাঁধলাম। জ্বালা তখনই আর অনুভূত হয়নি যখন তোকে প্যাডটা দিতে পেরেছিলাম রে।
কাকিমা তোকে নিয়ে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে দেখছিলাম তোকে। যেন এক ঝলক
পূর্ণিমার রাত কেউ নামিয়ে দিয়েছে শহুরে দুপুরে। হাতটা আগলে রেখেছিলাম যাতে তুই
দেখতে না পাস। সব যত্ন দেখায় না, দেখাতে পারে না জানিস তো। কারন ঐ যে শব্দের
বাইরেও এক জগত আছে যেখানে শব্দের প্রবেশ নিষিদ্ধ। চমকটা তখন ভাঙল যখন একটা টিকটিকি
কানের খুব কাছে এসে ডাকলো, টিক, টিক, টিক।
Comments
Post a Comment