“শুরুর কবিতা”
“শুরুর কবিতা”
- Dip Saha
Chowdhury(#রোদ্দুর)
মানব শরীর পৃথিবীর সবচেয়ে
জটিলতম যন্ত্র। একটা স্পন্দন যার সচল থাকার প্রমান কিন্তু বিশ্বাস করুন আজও বিজ্ঞান
এটা জানে না যে মানুষের ভ্রুনে প্রথম স্পন্দন ঠিক কখন শুরু হয়। কথায় বলে আমাদের হৃদস্পন্দন
আমাদের অনুভুতির সাথে পরিবর্তিত হয়। ভালবাসলে এর গতি একরকম, কষ্ট পেলে আরেক। রাগ
হলে এক রকম আবার ঘৃনা হলেই আরেক আবার এটা না থাকলে উপরের কোনটারই অস্তিত্ব থাকে
না।
২৬ শে নভেম্বর ২০০৮ –
সকাল থেকে মুড অফ করে বসে আছে লাবন্য। করাটাও অস্বাভাবিক না। আজ অমিত বাড়ি যাবে। মানে
মুম্বাই শহরে কর্মব্যাস্ত ছয় মাস কাটিয়ে আজ কলকাতা ফিরবে অমিত। এই অফিসের গ্রাউন্ড
ফ্লোরের করিডোরে এক ব্যাস্ত সকালে দেখা হয়েছিল তাদের। দুজনেই একই অফিসে কাজ করে তবে
ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন। অমিত ৫ম ফ্লোরে আর লাবন্য ৭ম।
[আজ থেকে ছয়মাস আগের কথা।]
গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে
টিফিন ব্রেকে সিগারেটে টান দিচ্ছিলো অমিত। এমন সময় একটু শান্ত ও ধীর গলায় একটা
মেয়ে বলল, “আগার আপ বুরা না মানে এক সিগ-রেট মিলেগা??” কথার টান দেখে অমিত বুঝলো এ
বাঙালি । কারন ভাই আমরা যতই নিজেকে সব ভাষায় পটু করার চেস্টা করি বাংলা ভাষা পেটের
ভিতর থেকে ঠিক বলে উঠবে – “কি রে আমার খেয়ে , আমার পড়ে আমায় ভুলে গেলি??” অমিত তাই
বলল- “এই নিন।”। লাবন্য কিছুটা খুশি হয়ে বলল, “আসলে সিগারেট টা বাড়িতেই... আরে...আপনি...”।
কথাটা শেষ হলো না লাবন্যের। অমিত বলল- “বাংলা মায়ের বাংলা সন্তান। হাই আমি অমিত”।
লাবন্য কিছুটা গদগদ হয়ে বলল, “আমি লাবন্য।” অমিত ভ্রুটা উচু করে, সিগারেটটা দিয়ে
বলল, “আসল নাম টা?? ” আগুনটা ধরিয়ে দেশলাই কাঠিটা নিভাতে নিভাতে লাবন্য বলল, “মানে??”
দেশলাই কাঠিটা তখনো তার শেষ ধুয়োটাকে বাচিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। অমিত
বলল, “না মানে অমিত লাবন্য, শেষের কবিতা ভার্সান ২.০ নাকি??” অমনি লাবন্যর ফর্সা
মুখ রাগে লাল হয়ে উঠলো। নীলচে ধোঁয়ার মাঝে থেকেও সেটা বেশ টের পেলো অমিত। লাবন্য
গজগজ করে উঠলো, বলল, “আপনার মনে হচ্ছে আমি ঢপ দিচ্ছি??” ভয়ার্ত গলায় অমিত বলল, “আহা
চটছেন কেন?? নাম যদি একই রকম হয় দোষ তাহলে রবি স্যারকে দেবেন আমি তো মজা করছিলাম।”
মুম্বাইয়ের ভ্যাপ্সা ওয়েদারে শীত তেমন নামে না। অফিসের সামনে একটা ঝর্না আছে সে দিকে
তাকিয়ে লাবন্য বলল, “আপনার আসল বাড়ি কোথায়?” অমিত বলল, “লেক গার্ডেনস, আপনার??” চোখ
না সরিয়ে লাবন্য উত্তর দিলো- “শান্তিনিকেতন।” অমিত বলল, “তার মানে নামটা বাবা নিশ্চই
ভেবেই রেখেছিলেন। ” । নিজের হাতের সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলো লাবন্য।
তারপর মুখের কাছে হাত নাড়িয়ে ধোঁয়া সরাতে সরাতে বলল, “আমার বাবা আর আপনার রবি
স্যার জানেন... আমি জানিনা...” এই বলে অফিসের কাঁচের দরজার দিকে পা বাড়ায় লাবন্য।
পিছন থেকে অমিত বলে- “যদি কিছু মনে না করেন... মানে এখানে... বাঙালি তেমন কেউ নেই
তাই যদি কথাবার্তাটা একটা রুটিন হয়ে যায়... তাহলে আরকি মানে...” লাবন্য কিছুটা হাসি
চেপে বলল, “ কেন?? আপনার শেষের কবিতার কেডি কে খুঁজুন... দেখুন আশেপাশে ঠিক পাবেন...
রবি ঠাকুর যখন লিখেছেন তখন আশেপাশে মালটা কোথাও আছে।” এই বলে দরজা ঠেলে... ঢুকে
গেল।
কোনো মতে দিন কাটল অমিতের
, সন্ধ্যেবেলা আনমনে বাড়ি ফিরলো সে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ডিনার সেরে গা এলাতেই চোখের সামনে র্যাকে চোখে পড়ল শেষের
কবিতাটা।বইটা আনমনে তুলে নিল অমিত। বইটা খুলে আছে কিন্তু মনে যেন সকালে লাবন্যের
হাসিটা ভাসছে। হঠাত মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। লাবন্য যে ফ্লোরে কাজ করে সেখানে
এক বন্ধু আছে। তাকে ফোন করে বিরিয়ানি খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ফোন নাম্বার অধিকার
করে। নাম্বার পেয়েই প্রথম ম্যাসেজ করে অমিত। “হাই... আমি অমিত।”। কোনো উত্তর আসে
না আধ ঘন্টা। এই আধ ঘণ্টা প্রতি মুহুর্ত তার মনে হয়েছে সে ভুল। হঠাত ফোনটা বিপ কর
উঠলো। রিপ্লাই... “ কেডিকে পেলেন না... ” ... মুখে হাসি ফুটে উঠলো... লাফিয়ে বিছানায়
পড়লো... শুরু হল নতুন ইতিহাস লেখা...
আজ ছয়মাস হয়ে গেল... ওরা ...
একে অপরকে চিনেছে... জেনেছে... আজ তারা একে অপরের সব কিছু... সব জানে... সব মানে...
ভালোবাসে একে অপরকে... না এ গল্পে কোনো কেডি নেই। বাড়ি ফিরবে অমিত... আজ অফিস
আসেনি অমিত... ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনালে সেদিন এক ব্যাস্ত সন্ধ্যা... ভিড় ভেঙ্গে
পড়ছে স্টেশনে। ভিড়ের এক কোনে লাবন্যের চোখে পড়লো একদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অমিতের দিকে।
তার চোখে চোখ পরতেই হাসল অমিত। চোখ ছলছল করে উঠলো লাবন্যের। ভিড় ঠেলে এগোতে গেল...
লাবন্য। হঠাত এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ স্টেশনে চত্বরে। চারিদিক ভরে গেল ধোঁয়া আর
বারুদের গন্ধ। একটা গুলি এসে লাগলো অমিতের বাঁদিকে। রক্ত এসে পড়ল মেঝের চারিপাশে...
২৬/১১ এর সেই রাতে যে গুলি চলেছিল তাতে মৃতদের সেই লিস্টে থাকতে পারত অমিতের নাম।
কিন্তু ভাগ্য মাঝে মাঝে এমন কিছু চমক তৈরি করে রাখে যা হয়ত আমরা স্বপ্নেও কল্পনা
করতে পারব না। সেই হুরহুরিতে মেঝেতে পড়ে যায় লাবন্য। মানুষের স্তুপে পড়ে প্রান বেঁচে
যায় তার কিন্তু সে ভেবেছিলো হারিয়ে ফেললো সে অমিতকে। কিন্তু অমিত এক অদ্ভুত বিরল বৈশিষ্টের
অধিকারি ছিলো। তার হৃদপিণ্ড সেদিন থমকে যায়নি শত গুলির আর্তনাদে কারন তার হৃদপিণ্ড
ছিলো বুকের ডান দিকে। পৃথিবীতে এই বিরল রোগের নাম Dextrocardia.
সেদিন থমকে যায়নি অমিত-লাবন্যের শেষের কবিতা। বরং
হসপিটালের চত্বরে তারা জন্ম-মৃত্যুর উর্দ্ধে গিয়ে লিখেছিলো “শুরুর কবিতা”। বলতেই
পারেন শেষের কবিতা ভার্সান ২.০।
Comments
Post a Comment