রোদ্দুর
রোদ্দুর
- Dip Saha Chowdhury
(#রোদ্দুর)
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ
প্রায়। কয়েকদিনে গরমের প্রকোপ এতোটাই বেড়ে গেছিলো যে শহরের পিচগুলি তার মাশুল গুনছিল।
আগের রাতে বেশ কালবৈশাখীতে স্বস্তি পেয়েছে শহরতলির অলিগলি। ঈশানকোনে যে কালো মেঘ কাল
ঝড় নামিয়েছিলো তার প্রভাবে সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে। কফির মগটা নিয়ে বাইরে দাঁড়ালাম।
সেখান থেকে একটু একটু করে ধোঁয়া উঠে বাতাসে মিশে কোনো অজানার দেশে পাড়ি দিচ্ছে। আমার
ব্যালকনির কার্নিশ থেকে একটু একটু জল এসে ব্যালকনির মাটিটা ভিজিয়ে তুলছে। কাল রাতে
একটা দুঃস্বপ্নে ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। কাউকে বলতে পারিনি। হঠাত দেখলাম আমার খাট নড়ে
উঠলো। একটা ছায়ামূর্তি আমার দিকে পা বেয়ে উঠে আসছে। মুখের কাছে আসতেই দেখলাম আরে এটা
তো আমিই। কিন্তু মুখে কি বিকৃত হাসি, যেন পাতালের কোনো অন্ধকার থেকে তার রুপ নির্ধারন
করা হয়েছে। এ হাসি তো আমার নয়। কিন্তু এ কি ... সে আমার গলা টিপে ধরছে। আমি শ্বাস
নিতে পারছি না। সে হাসতে হাসতেই বলছে তোর দ্বারা কিছু হবে না। তোর বাঁচা উচিত না। ঘুম
থেকে ধরমর করে উঠে দেখলাম কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। আর বুকের কাছটা একটু চাপা
ব্যাথা। বুঝলাম বোবায় ধরেছে। একটু উঠে কাঁপা কাঁপা পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগোলাম। গলাটা
কেমন কাঠ হয়ে আছে। রান্নাঘরের দরজা খুলে দেখলাম সব কিছু তছনছ হয়ে আছে। জানলাটা আটকানো
হয়নি। আর ঝরে সব পড়ে গেছে। একটা কাঁচের গেলাসে অনেকটা জল নিয়ে গলায় ঢেলে দিলাম। এরপর
আবার গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘড়ির কাটা তখন আরাইটের ঘরে অবস্থান করছে। এপাশ ওপাশ করতে
করতে কখন ঘুম এসেছে জানি না । আবার একটা স্বপ্নে ঘুমরাজ্য তছনছ হয়ে গেল।দেখলাম আমি
একটা ফাঁকা ঘরে শুয়ে আছি, আর ঘরের চারকোনে চারজন বসে যাদের একজনকে আমি চিনি আমাদের
স্কুলের শশাঙ্কবাবু। ক্রমাগত অস্পষ্ট ভাষায় বলছেন- বলেছিলাম পারবি না?? আর কথাটা
যেন সারা ঘরে ইকো হচ্ছে। আর বাকি অজানা তিনজন আমার দিকে এক অদ্ভুতভাবে আমারদিকে
তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো অভিব্যাক্তি নেই যেন তারা কিছু দেখতেই চাইছে না শুধু তাকিয়ে
আছে। ঘুম ভেঙ্গে চোখ ফেটে জল এলো। কাছের কোলবালিশটাকে জড়িয়ে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম।
নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিল। যে সত্যি আমি কি এই পৃথিবীর কাছে বোঝা। চিরকাল থেকেই
আমি একটু জেদি প্রকৃতির কিন্তু এক জ্যোতিষী আমায় বলেছিলেন তোর জেদ চিরকালই সৃষ্টিকে
রুপ দেবে কিন্তু কোনোদিন তা বিশ্বাস করিনি। ২০১১ সালে আমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা আসে
যদিও আমি তার কাছে শুধুই একটা টাইমপাসের খোরাক
ছিলাম। যেদিন সে চলে গেছিলো আমার কাছে মৃত্যুটাই শ্রেয় মনে হয়েছিলো, হতোই না বা
কেন?? প্রথম আঘাত, আমি জানতাম না এগোতে কি করে হয়। সেই সময় আমার মন আমাকে সেই কথাগুলোই
বলেছিলো যা আমি চাইতাম না কেউ আমায় বলুক। ঘা টা সারতে আমার বেশ কিছু বছর সময় লেগেছিলো।
তারপর কাউকে মন থেকে চাওয়ার সাহস পাইনি। যে মনকে অনেক কষ্টে জুড়েছিলাম তা ভাঙতে
পারে এ ভয়টা আমাকে ভিতর থেকে মাকড়শার জালের মতই আটকে রেখেছিলো। এসব ভাবতে ভাবতেই
সিলিঙে এ চোখ পড়লো। দেখলাম একটা টিকটিকি সিলিঙে একটা পোকাকে ধরার জন্য ওত পেতে রয়েছে
আর নিজের মুখটা জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছে। কতোই বিচত্র এ জীবন মৃত্যু যেখানে অত পেতে থাকে
প্রতি মুহূর্তে। আমার জীবনের শুরুটা ঠিক যেমনটা হয় তেমনটা নয়। সেটা ভাবতে ভাবতে
নিজের ডান হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরলাম। ঘরের হালকা সবুজ নাইটল্যাম্পে দেখলাম হাতের
আয়ুরেখার শুরুতে হিজিবিজি দাগগুলো। ছোটোবেলায় এক দাদু হাত দেখে বলেছিলেন এ ছেলে
দ্বিজন্মা। তখন তার মানে বুঝিনি। বড়ো হয়ে মানে শুনেছিলাম মায়ের কাছে। মা বলেছিলো
আমি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন আমাকে মারার জন্য আমার খুব কাছের মানুষেরা মায়ের খাবারে
বিষ মেশায়। তারা চায়নি আমি এ পৃথিবীতে আসি কিন্তু তাতে আমার অনেকটা ক্ষতি হয়েছিলো ঠিকই
কিন্তু মৃত্যু হয়নি। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণ যেমন পরীক্ষিৎকে মাতৃ গর্ভে পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন
ঠিক তেমন। কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়। মাতৃগর্ভে আমার ঠাই হয় মাত্র ৭ মাস। আমি এক Pre-Matured Baby. যার ওজন ছিলো
মাত্র ১ কেজি ৭০০ গ্রাম। যে বয়েসে মানুষের অনেক অংশ সুগঠিত হয় না। সেই বয়েসে পৃথিবীতে
নামতে হয়েছিলো আমায় এ পৃথিবীর যুদ্ধে। কথায় বলে মাতৃ জঠর মানুষের শান্তি নিবিড়।
আমার জন্য সেটাও কম ছিলো। হাতের তালুর মতো ছিলো আমার আকার। সবাই নিশ্চিত ছিলো মৃত্যু
নির্ধারিত আমার। কারন এ পৃথিবীর সঙ্ঘাতের জন্য আমি তৈরী নই আমি।কিন্তু আমার মায়ের চ্যালেঞ্জ
আমাকে বাঁচার উষ্ণতা দিয়েছিলো। বাবা মায়ের ভালোবাসা আমাকে কখনো দমতে দেয়নি। উঠে পড়লাম।
নাহ মরতে তো আসিনি আমি।
কফিটা কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ওর উপর টুপ টুপ করে বৃষ্টির জল পড়ছে। নাহ ওটা আর খাওয়া যাবেনা। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করি। লেখালিখি ধুস আমি তো বাংলায় কোনোদিন ভালো নাম্বারই পেলাম না... আর লেখালিখি... হঠাত দেখলাম ব্যালকনির এক কোনে একটা পুরানো কাগজ পড়ে আছে। হেডলাইনে বড় করে লেখা মৃত্যুর মধ্যেও জীবন খুঁজছে ‘গ্রাউন্ড জিরো’
-
“একটা শহর। যে শহরের বুকে ভেঙে পড়া একটা উড়ালপুলের সামনে কিছু ছিন্নভিন্ন লাশ আর কিছু দোমড়ানো মোচড়ানো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলেন কেউ কেউ। আর সেই শহরেই, ওই একই ভেঙে পড়া ফ্লাইওভারের সামনে নিজের সব টুকু দিয়ে আহত, রক্তাক্তদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, অনেকে, হ্যাঁ, অনেকেই। পুলিশ আসার ঘণ্টা দুই আগে থেকেই যাঁরা ওই ভয়ঙ্কর ধ্বংসাবশেষ থেকে যে কোনও ভাবে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টায় মাতেন। মধ্য বয়সী কোনও প্রৌঢ় বেলচা দিয়ে, প্রাণপন চেষ্টা চালান দানবাকৃতি সিমেন্টের চাঁই সরানোর। ব্যর্থ হন বা ব্যর্থ হবেন জেনেও চেষ্টাটা কিন্তু থামান না। আহতদের ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে হুড়োহুড়ি পরে যায়। যদি বাঁচানো যায়। সেই আশায় চাপা পড়া কোনও এক মুমূর্ষুর মুখে জল তুলে দেন। আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া সেই শরীরটার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠেন। উদ্ধারকাজে পুলিশ, সেনা জওয়ানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাত জাগেন বহু মানুষ। ভোরেও একই উদ্যমে জড়ো হন, মানুষের জন্য, প্রাণের টানে।”
-
৩১ শে মার্চ ২০১৬
তে ভেঙ্গে পড়া উড়ালপুলের নিচে চাপা পরা মানুষদের মধ্যে ধরা দিলো আমার তৈরি চরিত্র “সৃজন”।
মৃত্যু হল ঠিকই কিন্তু জন্ম হল রোদ্দুরের। আজকের দিন ২৭শে এপ্রিল ২০১৬। এরপর একে
একে রাগিনী, ইমন, সম্বিত, সন্দীপতা সবাই এলো একে একে। এভাবেই জন্ম হয়েছিলো
রোদ্দুরের।
Comments
Post a Comment