আত্মা
আত্মা- এটা বিষয় না বিস্ময় তা নিয়ে আজও আমার চমক কাটে নি। আগেই বলে রাখি
আত্মা হল এমন একটা কন্সেপ্ট যেটা জানতে সারাজীবন লেগে যায় তবুও জানা শেষ
হতে পারে না। অনেকে বলেন এটাই মহাবিশ্ব, কর্ম চক্রের আদি আর কর্মচক্রের
অন্তিম আর এটাকে যে জেনে গেছে সে এই কর্মচক্র, জীবন, মৃত্যু থেকে মুক্ত
হয়ে গেছে কারন তখন তার আর ঈশ্বরের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে নি। এবার কথা
হল আত্মাটা আসলে কি? “আত্মা” এটি একটি
সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ নিজে। অর্থাৎ আত্মাই আপনার প্রকৃত পরিচয়। আপনার
নাম, সম্মান, পিতা, মাতা এগুলো কোনটাই আপনার পরিচয় নয়, বিশ্বাস হচ্ছে না?
ধরুন আপনার নাম যদি আকাশ না হয়ে নীল হতো, তাতে আপনি তো আপনিই থাকতেন।
গোলাপকে গোলাপ না বলে প্রলাপ বললে সে সেই গন্ধই ছড়াতো আবার যদি পলাশ ফুলকে
গোলাপ ডাকলে সে কখনই গন্ধ ছড়াত না। এরপর আসি সম্মানের ব্যাপারটায়। দেখুন আজ
আপনি একজন সম্মানীয় ব্যাক্তি কাল একটা ভুলে আপনি সম্মানহীন হবে মুহূর্তের
মধ্যে, তাহলে যে জিনিস মুহুর্তে বিলিন হয়ে যায় তা আপনার পরিচয় হতে পারে
কি?? আচ্ছা যদি আপনার পিতা , মাতা এনারা না হতেন তাও আপনার নাম আকাশ হতেই
পারতো। সুতরাং এগুলো কোনটাই আপনার পরিচয়টা কী? আত্মাই আপনার পরিচয়। যা সবার
একই। আপনার আত্মা আর আমার আত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। আর এটাই
বাস্তব চিন্তা যা প্রমান করে আমরা সবাই সমান। অহঙ্কার এখানেই মুল্যহীন।
আত্মার আচ্ছা এবার আত্মার ভুমিকাটা কী?? আচ্ছা আমাদের শরীর কি দিয়ে
তৈরী?? বিভিন্ন মৌল যেমন কার্বন , নাইট্রোজেন , অক্সিজেন, ইত্যাদি ইত্যাদি
কিন্তু ব্যাপারটা হলো যে আপনি যদি এই সব উপাদান দিয়ে শরীর তৈরি করেন। প্রান
দেবেন কি করে। কি এমন পার্থক্য মৃতদেহ ও জীবদেহের মধ্যে?? মৃতদেহ হল
জীবনশক্তিহীন জীবদেহ। যে শক্তি আপনাকে জীবিত রাখে তা হল প্রান আর প্রান হল
আত্মা। তাহলে এই রুপ উক্তি থেকে পাই যে আত্মা একটি শক্তি। আর শক্তির সংজ্ঞা
কী?? যার ভর নেই, আকার নেই, আয়তন নেই, শুধু পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি
করা যায়, এটাই আত্মারও সংজ্ঞা। কিন্তু আত্মার মুল কার্য কী বা এর ভুমিকা
কি? আসলে এ পৃথিবী , মহাবিশ্ব এক মহা কর্মযজ্ঞ আর আত্মাই সেই শক্তি যা এই
কার্য করে। কিন্তু আত্মা নিজে থেকে এ কাজ করতে অক্ষম কারন শক্তি কখনও কার্য
করতে পারেনা তার একটি মাধ্যম দরকার পরে। আর এই মাধ্যমটি আত্মার ক্ষেত্রে
এই মাধ্যমই হল শরীর যার আত্মার আধার বা ঘর। যেমন ধরুন শব্দ এক শক্তি কিন্তু
যখন আমরা উচ্চস্বরে গান চালাই তখন শব্দ শক্তি ঐ লাউডস্পিকারকে মাধ্যম করে
গান শোনায়। এবার কথা হল আত্মার প্রকৃতি কী?? দেখুন আত্মা এক শক্তি তাই এ
সবসময় নিরপেক্ষ। এর মধ্যে না রাগ আছে, না ক্ষোভ আছে , না আনন্দ আছে, না
দুঃখ আছে। এটি সব অবস্থাতেই স্থির, শান্ত, নীরব এবার কথা হল তাহলে মানব
শরীরে এগুলি আসে কি করে যদি আত্মা শান্ত হয়, কারন আগেই বলেছি যে আত্মাই
আপনার পরিচয়। তাহলে আপনি শান্ত নন কেন?? ইংরাজিতে তিনটি শব্দ আছে “Soul”,
“Mind”, “Spirit” যার বাংলা হল- আত্মা, জীবাত্মা, প্রেতাত্মা। আত্মা যে
শুধুই একমাত্র শক্তি যা নিরপেক্ষ, সব অবস্থাতেই শান্ত। জীবাত্মা হল আত্মা
যখন শরীরে অবস্থান করে। আসলে শরীর হল আত্মার কাজ করার মাধ্যম। আমরা এই শরীর
নিয়ে বড় হতে থাকি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। জীবনকালে আমরা বিভিন্ন ঘাত
প্রতিঘাতের মাধ্যমে শরীর তার কর্ম করে এই কর্মের মধ্যে যদি আমরা ফল খোঁজার
চেষ্টা করি বা অন্যের কর্মের সাথে নিজের কর্মকে তুলনা করতে শুরু করি অথবা
নিজের শরীরকে বা শারীরিক আনন্দকে বেশি প্রাধান্য দিতে শুরু করি তাহলে যেটা
হয় সেটা হল আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে ছটা রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ,
অহংকার, মোহ এবং ঈর্ষা জন্ম নেয় এবং এরা সবাই মিলে যেটা তৈরী করে সেটা হল
“মায়া”। যা আপনাকে আপনি হতে বা আত্মাকে বুঝতে বাধা দেবে এবং যতদিন আপনি এই
ষড়রিপুকে ত্যাক করতে পারবেন না ততদিন আপনি কর্মজজ্ঞে নিজেকে সম্পুর্ন রুপে
প্রদিন করতে পারবেন না অর্থাৎ আত্মা নিজেকে কর্মে উপস্থাপন করতে পারবে না।
এহেন অবস্থায় যদি আপনার শরীর আসতে আসতে সময়ের কবলে বার্ধক্য বা দুর্ঘটনার
কবলে পড়ে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন আর আত্মার পক্ষে ঐ শরীরকে চালিয়ে নিয়ে
যাওয়া সম্ভব হয় না তাই আত্মা শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরের খোঁজ নেয়, জন্ম
নেয়। কিন্তু যদি শরীর ছাড়ার মুহুর্তে আত্মা নিজে এই ষড়রিপুর সাথে জড়িয়ে পড়ে
তখন ষড়রিপু আত্মার প্রকৃতিকে অস্থির করে তোলে তার আকাঙ্খা পুরনের জন্য এই
সময় আত্মার স্বরূপ হয় ভয়ার্ত একে বলে প্রেতাত্মা। এ সর্বদা চায় একটি যা
আগের থেকেই পরিপুর্ন বা Readymade। ব্যাপারটা আরও খোলসা করে বলি একটা
কাঁচের গেলাস আছে, এবং তাতে একটি হীরে রাখা হল, এবার তাতে জল দেওয়া হল,
আপনি এখন হীরেটা দেখতে পারছেন এবার জলটাতে মাটি ঢালা হল, এবার আপনার কাছে
হীরেটা অস্পষ্ট হয়ে যাবে। ঠিক এমন ভাবেই ষড়রিপু আমাদের আত্মাকে আমদের শরীরে
স্বরুপ হতে বাধা দেয়। জন্ম মৃত্য চলতেই থাকে কারন আত্মা যে কাজ করতে এ
পৃথিবীতে এসেছে তা সম্পুর্ন হয় না। এবার একটা ব্যাপার স্পষ্ট করি... দেখুন
আত্মা চিরকালই পবিত্র, এর সাথে স্বয়ং ঈশ্বরের কোনো পার্থক্য নেই। আবার
আপনার আমার আত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আত্মাই আপনার আসল রুপ তার মানে
আপনার আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই বোধ এটাই বোঝায় কেউ ছোট বা বড় নয়
শুধু ষড়রিপু যা আমাদের শত্রু তা আমাদের পৃথক করে। এবার আমরা যদি আমাদের
আত্মাকে জেনে যাই, খুঁজে পাই তবে ঈশ্বরকে যেনে যাব। কারন ঈশ্বর আর আত্মা
একই শক্তি। উদাহরন স্বরুপ যেমন একটা ট্যাঙ্কে কিছুটা জল নিয়ে তাতে চিনি –
লবন মিশিয়ে সরবত বানানো হল। এবার একটি ট্যাপ দিয়ে ঐ শরবত কিছু গেলাসে ভরে
সবাইকে দেওয়া হল। যে সরবতটা দেওয়া হল তাতে চিনি ও লবনের পরিমান ঠিক যেমন
ট্যাঙ্কের জলের মতই হবে, তাহলে কি আর ট্যাঙ্কে গিয়ে জল চেখে দেখতে হবে কি
যে তাতে সব ঠিক আছে নাকি?? বা ফুটন্ত ভাত থেকে একটি ভাত তুলেই বোঝা যায় যে
হাঁড়ির বাকি ভাতের কি অবস্থা। অর্থাৎ আপনার প্রকৃত রুপ স্বয়ং ভগবান। এই
জন্যেই আমরা কারো সাথে দেখা হলে হাত জোড় করি যেমনটা ভগবানকে করি। এই জন্যেই
বিবেকানন্দ বলেছিলেন জীব সেবাই শিব সেবা।
Comments
Post a Comment