অগ্নিকন্যা
অগ্নিকন্যা
-
Dip Saha Chowdhury
“নারী” – এনারা যদি না থাকতেন
তাহলে হয়তো কোনোদিন উপন্যাস লেখার প্রয়োজনই হতো না। একটু ভেবে দেখুন নারীদের বাদ
দিয়ে আপনি রামায়ন , মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি কোনটাই সম্ভব নয়। নারীকে বলা হয় সৃষ্টির
সরলতম রুপ। সৃষ্টি তাদের হাত দিয়ে সুচনা হয়। আবার বিনাশ তারাই করেন। যে নারী সৃষ্টিকে
নিজের হাতে সাজিয়ে তোলেন আবার সেই নারীই সৃষ্টিকে ধ্বংস করেন এক লহমায়। আজকের গল্প
এরকমই দুই নারীকে নিয়ে। প্রথমজন সীতা অপরজন দ্রৌপদি।
সীতা – সেই সময় মিথিলা
রাজ্য খরায় পরিপুর্ন। বৃষ্টির দেখা নেই ১২ বছর ধরে। তাই মিথিলার রাজা ঠিক করলেন মিথিলার
শস্যক্ষেতে তিনি সোনার হাল চালাবেন। সেই হালের রেখায় পাওয়া গেল এক কন্যা সন্তান যাকে
পালন করার দায়িত্ব নিলেন জনক রাজা। মাটিতে হাল চালানোয় যে রেখা হল তাতে তার সন্ধান
পাওয়া গেছিল তাই তার নাম হয় সীতা। ভুমিতে তার জন্ম তাই তার নাম ভুমিজা। বৈদেহী
প্রদেশের রাজকুমারি বৈদেহী। জনক কন্যা জানকী। চাঁদের মতো শুভ্র তিনি তাই তার নাম
হয় সিয়া। কিন্ত এ গল্প সবার জানা। যে গল্প জানা নেই সে গল্পই আজ বলব। রাবন এবং
মন্দাদরির কন্যা ছিলেন এই সীতা। এক নারীর অভিশাপে জন্ম হয়েছিলো সীতার। অভিশাপ অনেকটা
এরকম ছিলো যে “তোর ঔরসে যে কন্যার জন্ম হবে সেই হবে তোর মৃত্যুর কারন। আমি স্বয়ং
লক্ষ্মী তোর ঘরে জন্ম নেব। কিন্তু আমিই পরজন্মে তোর মৃত্যুর কারন হবো।”। এ কথা জানতে
পারেন মন্দাদরি। নিজের হাতে তো আর নিজের স্বামীকে মরতে দিতে পারেন না। তাই নিজের
স্বামীকে বাঁচাতে জনক রাজার মাটিতে পুতে রাখেন রাবন কন্যাকে। কিন্ত সীতা যে সম্পদের
দেবী লক্ষ্মীর রুপ। ভুমির রক্ষাকারিনী ভুমিজা। তাই একদিকে যখন সীতা মিথিলাকে সমৃদ্ধ
করছেন তখনই তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছিল স্বরগপুরী লঙ্কা। ধনদেব কুবেরের ভুমি লঙ্কা।
সেই মুহূর্তে যোগী রাবন জানতে পারেন যে তার লঙ্কাপুরীকে বাঁচাতে পারেন স্বয়ং সীতা।
কিন্তু তার কারনেই তার মৃত্যু হবে এটাও জানা তার। তবুও তিনি কুণ্ঠিত হননি। খোঁজ চালিয়েছেন
স্বর্গ, মর্ত্য পাতালে। নিজ কন্যা ভুমিজাকে। এমত অবস্থায় সুর্পনখা এসে এক রমনীর বর্ননা
দেন। সেই বর্ননায় রাবন চিনে গেছিলেন তার কন্যাকে। না সেদিন কোনো লালসার বশে অপহরন
করা হয়নি সীতাকে। নিজের রাজ্যকে এবং তার মানুষদের বাঁচাতে সেদিন রাবন প্রতিষ্ঠা করতে
চেয়েছিলেন লক্ষ্মীকে। কখনো ছুঁয়েও দেখেন নি তাকে। এটাই আসল গল্প। সীতাকে যথার্থ
সম্মান করেছিলেন বলেই রাবনের মৃত্যুর পর তার অপর এক বটবৃক্ষকে স্থাপন করেছিলেন
সীতা। যাতে মানুষ তার ছায়া পায়। কিন্তু অযোধ্যা ফিরে আসেন রাম – লক্ষন – সীতা। প্রশ্ন
ওঠে সীতার সতীত্ব নিয়ে। যে পুরুষ তাকে সমস্ত যুদ্ধ জয় করে বাড়ি ফিরিয়েছিলেন সেই
পুরুষের মনে আসে সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন। নিজের সতীত্ব প্রমান করতে অগ্নি মুখর পাতাল
গর্ভে প্রবেশ করেন ভুমি কন্যা ভুমিজা। সবাই ভাবেন এখানেই গল্পের শেষ। না। এটাতো শুধু
শুরু ছিলো। তখন সনাতন ধর্মের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিলো যে এক নারী নিজের মনে সতী
হওয়া সত্বেও তাকে প্রমান দিতে হবে তিনি সতী না কি? একজন পুরুষের ক্ষমতাই থাকবেনা যে
সে তার সম্মান রক্ষার জন্য লড়তে পারবে?
আগুনে বিলীন হয়েছিলেন
ভুমিজা। সেই আগুন আবার জন্মেছিল। পুত্র সন্তানের আশায় এক যজ্ঞ করেছিলেন রাজা ধ্রুপদ আর সেই যজ্ঞের আগুনে জন্ম নিয়েছিলেন
অগ্নিজা। হ্যাঁ ইনিই মহাভারতের কারন হয়েছিলেন। ধ্রুপদ কন্যা দ্রৌপদি। যজ্ঞের আগুনে
তার জন্ম তাই তিনি যজ্ঞসেনী। পাঞ্চাল রাজকন্যা পাঞ্চালী। কৃষ্ণ তাকে মেনে নিতে হয় যে
তার ৫ স্বামী। এহেন কাজ তখন আর্যাবর্তে মহাপাপ। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন এ কাজ
জগত সংসারে পাপ হতে পারে কিন্তু তুমি শুদ্ধ মনে এ কাজ গ্রহন করেছ তাই তুমি সতী
হবে। অর্থাৎ সেদিন রামায়ন যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর রচিত
হয়েছিলো মহাভারতের মহারনে। আর সেদিন পঞ্চস্বামী এক নারীর সম্মান রক্ষ্যার্থে কুরুক্ষেত্রের
প্রান্তরে যুদ্ধে নেমেছিলেন এবং সেদিন রাম একা যে সম্মান সীতাকে দিতে পারে নি সে
সম্মান পঞ্চপান্ডব তাকে দিয়েছিলেন আজও পঞ্চসতীর অন্যতম তিনি। সেদিন কুরুখেত্রের
প্রান্তে ধর্মরক্ষার লড়াইতে সনাতনের বহু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলো... দুই অগ্নিকন্যার
নামে।
Comments
Post a Comment