শকুনির চোখে মহাভারত


শকুনির চোখে মহাভারত
-    Dip Saha Chowdhury
শিরোনাম দেখে ভাবছেন যে এ কি গল্প শুরু হল? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিখিত পদ্য এবং যে গাথা থেকে সনাতন ধর্ম হিন্দু ধর্মের সুচনা হয় সেই গ্রন্থকে দেখতে হবে একজন খলনায়কের চোখে?? কিন্তু বিশ্বাস করুন কোনো জিনিসের গোঁড়ায় পৌছানোই আমার ধর্ম। তাই এই মহাগাথার গোঁড়ায় পৌছাতে গিয়ে আমি যেটা দেখেছি তার ব্যাখাই এই প্রবন্ধে দেব। আমরা জানি মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজনীতিবিদ বলা হয়। কিন্তু মহাভারতের পাতা জন্ম দিয়েছিলো আরেক রাজনীতিবিদ তথা একজন ট্রাজিক হিরো – শকুনির। অনেকে মনে করেন পাশা খেলা থেকেই মহাভারতের যুদ্ধের সুচনা হয় কিন্তু আদতে পাশা খেলার বহু আগে এমনকি কৌরব ও পাণ্ডবদের জন্মের বহুবছর আগেই মহাভারতের গল্প বা কুরুক্ষেত্রের বীজ বোনা হয়েছিল কোনো এক কারাগারের অন্ধকারে। আসলে মহাভারতের আসল নায়িকা গান্ধারি যে না থাকলে এই মহাভারত লেখাই হত না বা লেখার দরকারই পড়ত না।
জ্যোতিষমশাই বললেন এ মেয়ের সাথে যার বিয়ে হবে তার মৃত্যু অবধারিত । চিন্তায় পরলেন গান্ধার রাজ সুবল । আর যাই হোক নিজের মেয়ের জীবন তিনি বিপন্ন করতে পারেন না। অবশ্য উপায় বাতলে দিলেন রাজ জ্যোতিষ। বললেন উপায় একটা আছে। তাকে ছাগলের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তাই করা হল। কিন্তু মেনে নিতে পারলেন না গান্ধার কন্যা বাসুমতি। মুখে কিছু বললেন না। পিতার আদেশ মেনে নিলেন। আর পুরো ব্যাপারটাই চেপে গেলেন রাজা। ঐদিকে গান্ধারির আবার বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের আয়োজক হলেন হস্তিনাপুরের মহামতি ভীষ্ম। বলে রাখা ভালো যে শকুনি তার পিতার ১০০ তম সন্তান ছিলেন এবং কনিষ্ঠতম। আবার বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেন গান্ধারি এবং ধৃতরাষ্ট্র। বিয়ের পরে গান্ধারি জানতে পারেন যে তার স্বামী অন্ধ, প্রথমে এক ছাগল ও পরে এক অন্ধের সাথে বিয়ে হওয়া মেনে নিতে পারেন নি গান্ধারি। আর্যাবর্তের সবচেয়ে সুন্দর নারী হয়েও তার ভাগ্যে এমন পরিহাস দেখে তিনি ঠিক করলেন যে পৃথিবী সৌন্দর্যের দাম দিতে জানে না সে পৃথিবীর রুপ তিনি দেখবেন না। নিজেকে কাপর বেধে অন্ধ করে নিলেন গান্ধারি। অপরদিকে ধৃতরাষ্ট্র জানতে পারলেন যে তিনি গান্ধারির দ্বিতীয় স্বামী এবং তার পূর্ব স্বামী একজন ছাগল। অর্থাৎ তার স্থান এক ছাগলের সমান। রাগে, ক্ষোভে তিনি ফেটে পরলেন। আদেশ দিলেন যে পুরো গান্ধার পরিবারকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হোক। সেখানে চলল অকথ্য অত্যাচার। প্রতিদিন তাদের ১০০টি করে অন্নের দানা দেওয়া হত জাতে পুরো পরিবার অনাহারে মারা যায়। কিন্তু গান্ধার রাজ ঠিক করলেন তাদের কেউ অন্ন গ্রহন করবেন না। সব অন্ন তাদের কনিষ্ঠ পুত্রকে দেওয়া হবে যাতে সে তাদের এই অত্যাচারের বদলা নিতে পারেন। একে একে শকুনির চোখের সামনে মৃত্যু হল তার ৯৯ ভাইয়ের। গান্ধার রাজ শকুনিকে কথা দিতে বললেন যে তিনি যেন এ অপমানের বদলা নেন। তার ডান পা ভেঙ্গে দেওয়া হল যাতে যতবার তিনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন তার ব্যাথা তার অপমানের কথা মনে করিয়ে দেবে। মৃত্যু হল গান্ধার রাজ সুবলের। তার দেহ ত্যাগের আগে তিনি শকুনিকে বলে গেলেন যে তার মৃত্যুর পরে তার অস্থি কখনই পুড়বে না। ঐ অস্থি দিয়ে যে পাশা তৈরি হবে তা দিয়ে চিরকাল শকুনির মনের কথা শুনবে। এটাই হবে তার অস্ত্র। গান্ধার রাজের মৃত্যুর পর শকুনিকে মুক্ত করে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু তিনি হস্তিনাপুরে রয়ে গেলেন। একে একে ঘটনাক্রমে এলো সেই পাশা খেলার দিন। সেদিন আসলে সবাই ভেবেছিলো যে কৌরবদের জয় হয়েছিলো আদতে তা নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মস্তিস্কের গভীরে তখন কৌরবের মৃত্যু ঘুটি সাজাচ্ছিলেন স্বয়ং তাদেরই মামা। ছল করে অজ্ঞাতবাসে পাঠালেন পঞ্চপাণ্ডবকে এবং তাদের পুরিয়ে মারার এক ষড়যন্ত্র করলেন এমন এক মিথ্যে ষড়যন্ত্র যেখানে যা দেখা যায় তা হয়না। ঐ অগ্নিদগ্ধে কোনোদিনই পাণ্ডবরা মরত না কারন স্বয়ং শকুনি তাদের মরতে দিতেন না। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে সেদিন আদতে কোনো লড়াই হয়নি। কারন সে যুদ্ধে লড়াই হয়েছিলো শকুনির মস্তিস্কে। যেভাবে সেদিন যুদ্ধের প্রান্তকে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই যুদ্ধ হয়েছিলো। কৃষ্ণ যিনি সর্বজ্ঞানী তাকে কখনই সে ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় নি যখন শকুনি ষড়যন্ত্র রচনা করেছেন কারন তিনি জানতেন যে এ মহাবিশ্বের আদিতে এবং অন্তিমে যেমন তিনি আছেন তেমনেই এ মহাভারতের মহাগাথায় শকুনি আছেন এক নায়ক হিসাবে। নিজের মৃত্যু নিশ্চিত বা পরাজয় নিশ্চিত জেনে যে মানুষটি নিজের ধর্ম রক্ষা ও পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে নিজে দাড়িয়েছিলেন ইয়িনি হলেন শকুনি। তার চোখেই আসল মহভারত দেখা সম্ভব।
তিনি খলনায়ক নন বরং তিনিই নায়ক। অন্তরালে।  

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফিউসবক্স (Sequel of কলেজস্ট্রিট)

“ওম”

♥ ♥ ব্যারিকেড ♥ ♥