কাঁচের দরজা





কাঁচের দরজা
( রাগিনী – ইমন সিরিজ)
-Dip Saha Chowdhury

“কিছু শব্দ কখনও কখনও মনের অজান্তেই চোখের সামনে ভয়ানক স্মৃতির দরজা খুলে দেয়, যে স্মৃতিগুলি থেকে আমরা ক্রমাগত পালিয়ে বেরাতে চাই”
অফিস বাসটা আজ বরাবরের মতই লেট। অবশ্য ড্রাইভারকে দোষ দিয়ে কি লাভ?? এই কুয়াশাতে লেপের আলিঙ্গন ছেড়ে ওঠা একটা বিশাল ব্যাপার।। বাসে উঠে সবে গা টা সিটে ছেড়ে কুয়াশা ঢাকা শহরটাকে উপোভোগ করছি অমনি বাসের পাশ ঘেঁষে একটা আম্বুলেন্স চলে গেলো। এই শব্দটা আমি একদমই সহ্য করতে পারি না। শব্দটা যেন সেই দিনটার কথা মনে করিয়ে দেয়। আজও মনে হয় ওই দিনটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো
কয়েক মাস আগে... এরকমই এক সকালে হঠাত নেমে আসে দুঃস্বপ্নের রাত,
-         হ্যালো, শুনতে পারছিস??
-         হ্যাঁ, রাগিনী বৌদি... শুনতে পারছি।
-         কি বললি? আরেকবার বল!
-         আরে না না। মানে , তুই বৌ আর পাশে এক দিদি বসেছে । দুজনে একসাথে বৌ-দি।
বাসে পাশে বসে থাকা এক কলিগ মুচকে হেসে দেয়। আমিও সেই দিকে ইশারায় একটু হেসে দিলাম।
ঐদিকে রাগিনী জোর গলায় বলল,
-         জানিস, একটা ছেলে তখন থেকে ঝারি মারছে... ভাবছি...
-         ভাবনার মা পালিয়ে গেছে... তুই ঘুরে দাড়া।
-         না মানে, ঘুরে দারালে, কেসটাও ঘুরে যাবে... মানে... You Know What I mean??
-         তাহলে চলে আয় ওখান থেকে ...
-         এ বাবা, কেন?? জানিস আজ ওই ... ওই ড্রেসটা পড়েছি।
-         কোনটা??
-         আরে ওই যে যেটাতে আমাকে নাকি ...
-         না... এটা কেন?
-         চেঁচাবি না... আমি বৌদি?? তাহলে দাদা ধরে নেব...
-         আরে রেগে যাচ্ছিস কেন???
-         না , রেগে যাবে না... হুহ। এই শোন-না... আমি একটু কলেজ এসেছি। একটু কাজ ছিলো...
-         আগে বলিস নি তো...
-         আরে না মানে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি একজন এসএমএস করলো... তাই আরকি... খেয়ে বেরিয়েছি... চিন্তা করবি না... কিন্তু জানিস, কেন জানিনা আমার না আজ রাস্তাটা পার করতে ভয় লাগছে।
-         চিন্তা করিস না... ফোনটা ব্যাগে রেখে ... রাস্তাটা পার হ ।
-         জানিস আজকে তোর হাতটা খুব মিস করছি। রাস্তা পার হওয়ার সময় তুই সামনে থাকলে তোর জামার আস্তিনটা ধরে রাখি আজও। জানিস এমন নয় যে  আমি একা রাস্তা পার হতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস কর... তুই সাথে থাকলে আমি একা রাস্তা পার হতে চাই না। কেন জানিনা মনে হয় তুই সাথে থাকলে ট্রাফিক সিগন্যালগুলির দরকার পরে না। চোখ বন্ধ করে নিলেও ভয় লাগে না।
-         আচ্ছা বুঝেছি... এবার রাস্তাটা পার হ... নাহলে সূর্যাস্ত হয়ে যাবে
সামান্য হেসে রাগিনী বলে,
-         শোন না, আমি ফোনটা রাখি পরে ফোন করছি।
-         ওকে... লাভ ইউ।
ফোনটা ছেড়ে একটু স্বস্তির নিঃস্বাস নিই আমি। কতোটাই না ভালোবাসে আমায়। পাশ থেকে এক কলিগ বলে,
-         ইমন, You Know You’re Very Lucky..
আমি বললাম
-         রেগে গেলে বোঝা যায়... ভাই কতো lucky আমি।
বাসে তখন হাসির রো ওঠে।
কিছুক্ষন পর, ফোনটা আবার বেজে ওঠে... হুম রাগিনী, নিশ্চয়ই পার হয়ে গিয়ে বলবে “ইয়ে... পার হয়ে গেছি...”
ফোনটা ধরে আমি বললাম,
-         বলুন বৌ...
কথা শেষ হওয়ার আগেই কোন হট্টগোলের মাঝে এক ভারি গলা বলল,
-         হ্যালো।।
আমার ব্যাপারটা কেমন যেন... ভালো লাগলো না... বললাম,
-         কে...... কেহ...
-         স্যার , ম্যাডামের আক্সিডেণ্ট হয়েছে।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, যেন মাথার ওপর আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো,
-         কি... কি বলছেন??
আমার চিৎকারে বাসটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো... আমার মনে হলো চারিপাশের সময়টাও যেন কেউ থামিয়ে দিয়েছে... সেই লোকটি বলল,
স্যার আমরা ওকে কাছের ওঙ্কারে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি চলে আসুন... বাসের কলিগরা কিছু একটা আন্দাজ করে আমার পাশে এসে স্বান্তনা দিলো। কিন্তু আমার কানে তখন সেই এক্টাই শব্দই বাজছে... “ম্যাডামের আক্সিডেণ্ট হয়েছে।...”
ঐ রাস্তাতে আমি একটি ট্যাক্সি ধরে হস্পিটালের দিকে রওনা হই। বুকের প্রতিটা স্পন্দন যেন আমি শুনতে পারছিলাম। কানের পর্দায় তারা এসে কলরব করছে। একটা ঘন্টা যে কত দীর্ঘ হতে পারে সেদিন টের পেয়েছিলাম... হস্পিটালের গেটে এসে যেন আমার পা থমকে গেছে। পা আর এগোতেই চাইছে না... তবুও এগোতে হবে... এগতেই হবে... রিসেপশনে গিয়ে বললাম
-         রা... রাগিনী... অ্যাক্সিডেন্ট...
কথাগুলিও কেমন যেন... জড়িয়ে যাচ্ছিলো...
-         স্যার 1st floor, 103
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম... ১০৩ ... কাঁচের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখার সাহস আমার ছিলো কিনা জানি না, বা কে এই সাহস তখন দিয়েছিলো আমি জানিনা । দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছে রাগিনী... পায়ে , মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখটা আমার জলে ভিজে এলো। কাঁচের দরজা ধিরে ধিরে ভাপে ঝাপসা হয়ে এলো... সঙ্গে রাগিনীর মুখটাও । দরজা ঠেলে ঢুকতে যাবো এমন সময় একটা ভারী হাত আমার কাঁধে এসে পড়লো,
-         ডাক্তার বাবু ভিতরে যেতে বারণ করেছেন।
সেই লোকটি যে আমাকে ফোন করেছিলো। তিনি আরো বললেন,
-         বাড়ির লোকদের খবর দেওয়া হয়েছে। একটু পরে আবার ডাক্তারবাবু আসবেন। যদি কোনোরকম দরকার পরে এই আমার ফোন নাম্বার। ফোন করে দেবেন।
আমার চোখ তখন লাল হয়ে এসেছে... ওনাকে একটা প্রনাম করলাম। তিনি বললেন,
-         এ... কি করছো।
আমি বললাম
-         শুনেছিলাম , বিপদের সময় ভগবান জন্ম নেন... আজ দেখেও নিলাম।
লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন।
-         কখনও, কোন মুহূর্তে যদি দরকার পরে। ফোন করো। আমি পাশে থাকবো।
বলে উনি আমাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
-         কিছু খাবে বাবা...
-         না কাকু... না...
-         সাবধানে থেকো... কারন এখন তোমার শক্তিই ওর শক্তি... গাড়ির ড্রাইভারকে পুলিশ ধরেছে... যা করার তারাই করবে ।
মানুষটি চলে গেলেন... বিশ্বাস করুন... সেদিন জেনেছিলাম সেই প্রবাদটি কতই সত্যি,
“একটি হাসপাতালের দেওয়াল , একটি মন্দিরের চাইতেও বেশি প্রার্থনা শোনে। ”
কিছুক্ষন পর ডক্টর এলেন, বললেন,
“ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে... কতটা সেটা জ্ঞান আসলেই বোঝা যাবে... একটা পা ভেঙ্গেছে, হাতের কুনুইতে ক্র্যাক হয়েছে। ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না।”
“৭২ ঘন্টা... ” মাথায় এই শব্দটা যেন হাতুরি দিয়ে আঘাত করছিলো... ও এতক্ষন কোনো কথা বলবে না... আমার সাথে... কোনো ঝগড়া হবে না?? যা আমিও কথা বলবো না... কিছুক্ষন পর একজন নার্স এসে ওর ফোনটা আমার হাতে দিয়ে গেলো। দেখলাম ২০টা মিস-কল। লেখা “বাবা”। দেখতে দেখতে কলটা আবার ঢুকল।
-         হ্যালো,
-         হ্যালো কে?
-         আমি ইমন কাকু,
-         তুমি কোথায় আছো?
-         আমি হাসপাতালে
-         আমিও তো হাসপাতালে...
-         হ্যা কাকু, ফাস্ট ফ্লোরে উঠে ডানদিকে।
কিছুক্ষনের মধ্যে ওনারা উপরে উঠে এলেন। কাকিমা ওকে দেখে কাঁদতে শুরু করলেন। এ অবস্থায় উনি আর কি করতে পারেন। যতই হোক মায়ের মন। আমরা কোনো মতে ব্যাপারটা সামলে কাকিমাকে বসালাম। কাকুকে ব্যাপারগুলো বলতে শুরু করলাম। ডাক্তারের কথা বলতেই দেখলাম কাকিমা চেয়ারের হাতলটা আঁকরে ধরেছেন। উনি শুধু ওর কাছে যাওয়ার জন্য  একটা বাচ্চার মতো আবদার করছেন আর হাউহাউ করে কাঁদছেন। আমার ভয় ছিলো যে উনি না অসুস্থ হয়ে পরেন। তাই আমরা পরমর্শ করে ওনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। কাকু আমার সাথে থেকে গেলেন।
“কি রে... ওঠ খাবি না... টিফিন টাইম তো শুরু রে” পেছন থেকে ডাকলো কেউ একজন... দেখলাম ছোটোবেলার রাগিনী টিফিনবক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... মিঠমিঠে হাসছে... হঠাত কেউ নাড়া দিলেন। চোখ লেগে এসেছিলো বুঝতে পারিনি। কাকু বলল,
-         তুমি খেয়ে এসো... আমি আছি...
সামনে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা অন্ধকার... যান্ত্রিক আলো গুলি রাগিনীর মুখে এসে পড়ছে। মুখটা দু হাত দিয়ে ঢেকে নিলাম। একটু ফ্রেশ হতে উঠে পরলাম। হাতঘড়িতে তখন রাত ১১ টা। হাসপাতালের বাইরে একটা চা এর দোকান ... রেডিওতে গান বাজছে... Kahin dur jab din dhal jaae Saanjh ki dulhan badan churaae Chupake se aaye”
এতো ভালো একটা গান যেন আমার কাছে বিষের মতো শোনালো। বললাম
-         দাদা, একটা চা...
দূরে একটা চাউমিনওয়ালা চাউমিন বানাচ্ছে... মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও চাউমিন কতো ভালো খেতো... ওতো চাউমিন কতো ভালো খেতো... আচ্ছা ও তো সারাদিনে কিছু খায়নি...
টাকাটা রেখে চা না খেয়েই চলে এলাম। এসে বসলাম চেয়ারে... কাকুর চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা আমার নেই। সেই সময় যদি আমি ওকে রাস্তা পার হতে না বলতাম তাহলে এগুলো হতো না... কিচ্ছু না... নিজের উপর রাগ , ঘৃনা জন্মালো... আজ আমার জন্য ওর এই অবস্থা। সে রাত কেমন কেটেছিলো আমি জানি।। ঘড়ির প্রতিটি স্পন্দন আমাকে প্রশ্ন করছিলো যে আমি এটা কি করলাম। সকাল হলো... কোনোমতে হলো... কাকুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠালাম। সঙ্গে রাগিনীর সুইচড অফ ফোনটি। ১০টার দিকে ডক্টরের সাথে কথা বলে উনি জানালেন যে,
“অবস্থা স্থিতিশিল, জ্ঞান আসেনি... এটুকুই”। হাসপাতালের থেকে বাইরে চলে এলাম যদি কিছু খওয়া যায়... একটা দোকানে... চা... আর পাউরূটি বললাম। সম্বিত ফোন করেছিলো... ওকে সব ঘটনা বললাম। এমন সময় একটা কল ওয়েটিং দেখালো। আননোন নাম্বার ফোনটা ধরলাম..
ফোনটা ধরার পর আর খাওয়া হয়নি আমার... সেই খাবারটাও ফেলে আসতে হয়েছিলো আমায়...
ফোনটি এসেছিলো... হসপিটাল থেকে...
-         হ্যালো... ইমন চৌধুরী
-         হুম বলছি
-         আমি ওঙ্কার থেকে বলছি।
কাঁপা গলায় বললাম,
-         ব...বলুন।
-         আপনার পেশেণ্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনি চলে আসুন...
আমি এক দৌড় দিয়েছিলাম। পাশের রাস্তাঘাট কিছু দেখতে পারিনি। এক লাফে হয়তো তিনটে করেও সিঁড়ি পেরিয়েছিলাম... যখন কাঁচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, ডক্টর ওর চেক-আপ করছে। আর ও ঘাড় ঘুড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি হচ্ছে। যেন সবে ঘুম থেকে উঠেছে, আর ওকে কেও ওর অজান্তেই অন্য বাড়িতে এনে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে... আমার দিকে চোখ পরতেই প্লাস্টার করা হাতের আঙ্গুলগুলি দিয়ে আমাকে আসার ইঙ্গিত জানালো। পা আমার এগোচ্ছিলো না...আমি ফ্লোরেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লাম। মাথাটা নিচু করে খুব জোরে কেঁদে দিলাম... ঠিক যেন কোনও পদাতিক সৈন্য যুদ্ধের শেষ সৈনিক হয়ে যুদ্ধ জিতিয়েছে। যেন আমার বহুদিনের প্রার্থনা পুর্ন হয়েছে। মাথাটা ফ্লোরে ঠেকিয়ে নিলাম...

এরপর কেটে গেছে তিন মাস... রাগিনী অনেকটাই সুস্থ। আজ ওর চেকাপ আছে... সকাল বেলাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে... ওর বিশ্বাস যে ডাক্তারের কাছে গেলেই নাকি ইঞ্জেকশান দেয়। তাই বলেছে আমি যেন তাড়াতাড়ি ফিরি... সত্যিই পাগলী একটা...

Comments

Popular posts from this blog

ফিউসবক্স (Sequel of কলেজস্ট্রিট)

“ওম”

♥ ♥ ব্যারিকেড ♥ ♥