।। বন্ধুর মতন ।।
।।। বন্ধুর মতন ।।
- Dip Saha Chowdhury ( #রোদ্দুর )
কলকাতার এক বিশিষ্ট স্থানে সায়েদ বা সৈয়াদ নামে এক জাতি ঘাটি গেড়েছিল। পরে সেখান থেকে সেই জায়গাটির নাম হয় সৈয়দপুর বা পরে অপ্রভংশ থেকে সোদপুর। আজ আমদের গল্পের শুরু সেই সোদপুর থেকে। বেশ কয়েকদিন আগে একটি কাজে সোদপুর গেছিলাম। সেই ষ্টেশনের একটি কোনে বসে এই গল্পের পটভুমি মাথায় আসে।
সাইকোলজি বলে যে, “ আপনি যখন রাতে ঘুমাতে পারেন না। তার কারন হতে পারে আপনি কারো স্বপ্নে জেগে আছেন” – এই গল্পে আমাদের নায়ক রাতে ঘুমাতে না পারার কারনে হয়তো কেউ স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে। জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নেবার অবসর পাবে। সবাই এক নয় সেটা জানার বোঝার সু্যোগ পাবে।।।।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেলো যখন শেষ ট্রেনটা যখন এক ঝকুনি দিয়ে থামল। রীনা তখন বাইরে তাকিয়ে দেখল সোদপুর স্টেশন এসে পৌছেছে। মহিলা কামরা জনশূন্য, হয়তো কিছুটা ঝোঁকের বসেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্তটা নিয়েছে রীনি। কিছু করারও ছিলো না তার কারন আজ বাড়ি না ফিরলে কাল SSC exam টা দেওয়া হবে না। আর রানাঘাট পৌঁছাতে পারলেই... বাড়ি স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের পথ।এই ভেবেই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল রীনা, স্টেশনে এসে দেখে দাড়িয়ে আছে ১১টা ৪০ এর রানাঘাট লোকাল। ট্রেনে উঠেই বন্ধুদের ফোন করে বলেছিলো যে সে উঠে গেছে ট্রেনে। বন্ধুদের গালাগালির মাঝে ফোনটা কেটে দিয়েছিল রীনা। কিন্তু হঠাত ট্রেনটা এতক্ষন দাঁড়িয়ে আছে কেন?? রীনা দেখলো আসেপাসে কেউ নেই। শুনতে পেল সামনের ভ্যান্ডারে কয়েকজন বলাবলি করছে যে সামনের লাইনে তিনজন কাটা পড়েছে সেই নিয়ে বেশ ঝামেলা হচ্ছে তাই ট্রেন বেশ কিছুক্ষন বন্ধ। অগত্যা রীনা সামনের একটা বসার জায়গা ছিলো তাতে এসে বসল। পুরো স্টেশনটা শ্মশানের মত লাগছে। সামনে একটা পার্টি অফিস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তবে সেটা বন্ধ। আকাশে কত অগুনিত তারার সমাবেশ। আচ্ছা আলোকবর্ষ দূরে কেউ কি ঠিক এমনভাবেই কোন অজানা স্টেশনে রাত কাটাচ্ছে। সেখানেও কি এখন মাঝরাত??
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘাড়ের কাছে একটা স্বাস ফেলার অনুভব হল। ওমনি রীনার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমবাহের স্রোত খেলে গেল...পিছনে ফিরে দেখতে পেল চারটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে । হাসছে।। হাসিটা স্বাভাবিক না। গা থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ বেরোচ্ছে। একজন সামনে এলো । একজন পেছনে রইলো বাকি দুজন দুপাশে বসলো। এই চক্রব্যুহের মাঝে সে তার হৃদ-স্পন্দনের শব্দ কানে শুনতে পারছিলো। একটু দূরে কোন একজন চা দোকানদার দূরে দাঁড়িয়ে অবস্থাটা দেখছিল। রীনার চোখে চোখ পরতেই সে দোকান গোটানোর ব্যাবস্থা করতে লাগলো। এরই মধ্যে একটি হাত রীনার পেছন থেকে তার জামার ভেতরে প্রবেশ করলো। সে চেঁচাতে চেয়েও চেঁচাতে পারলো না। কারন এই শ্মশানশুন্য প্লাটফর্মে তার আর্তনাদ শোনার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে নেই। দুটো হাত তার উরুর উপরে উঠে এলো। সে চাইলেও উঠতে পারছে না। যে হাতটি এতক্ষণ পেছনে হাত বোলাচ্ছিলো সে আচমকাই তার স্তন যুগল চেপে ধরলো। প্রচণ্ড আর্তনাদে তখন চেঁচিয়ে উঠল তার গলা।কিন্তু ঐ যে শোনার কেউ নেই, উরুর কাছে থাকা হাতটি ততক্ষণে অনেকটাই উপরে উঠে এসেছে। ঠিক এই মুহূর্তে ছায়ামূর্তির চক্রব্যুহ ভেদ করে একটি শব্দ এলো-
- ঊর্মি!! কাকু আর একজন পুলিশ কন্সটেবেল তোমাকে নিতে এসেছে। এতো রাতে তোমাকে না পেয়ে ওনারা থানায় গেছিলেন। এসো।
পুলিশের নাম শুনে ছায়ামূর্তি কোথায় যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। রীনা দেখল একটি বছর পঁচিশের ছেলে তাকে ইঙ্গিত করে ডাকছে। বিশ্বাস করতে মন চাইছে না তাও উপায় নেই তাই সেদিকে এগিয়ে গেল। ভয়ে তার পা কাঁপছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলো কোনো পুলিশ নেই। আবার ফাঁদ?? হঠাৎ ছেলেটি বলে উঠলো
- সরি ম্যাডাম, মিথ্যে কথাটা বলতে হল। নাহলে আজ আপনাকে বাঁচাতে পারতাম না।
- কিন্তু আমার নাম তো ঊর্মি না... আমি রীনা।
ধরা গলায় বলল রীনা,
- সে রীনা হোক, বীনা, মীনা... কারো না কারো বোন তো?, আমি আকাশ, চলুন...
- কোথায়?
- ভয় নেই। সামনে একটা পুলিশ আউটপোস্ট আছে। আপনাকে সেখনে পৌছে দিতে পারলে। আমার কাজ শেষ। কেন আমাকে ভয় করছে?
রীনা ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সে আমতা আমতা করে বলল
- না... মানে...
- স্বাভাবিক। একটু আগে যা ঘটল... তাতে এটা অবাক করা কিছুই না।
কথা না বলে পা বাড়ায় রীনা। আকাশও কোনো কথা বলে না। হেঁটে চলে। রাস্তায় হাটার সময় রাস্তার দুপাশে অন্ধগলির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠতে থাকে রীনা। কিন্তু স্ট্রিটলাইটগুলি আবার বুঝিয়ে দিচ্ছে কেউ হয়তো পাশে চলছে। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আকাশ প্রশ্ন করল
- এতো রাতে স্টেশনে কি করছিলেন?
যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সব কথা বলে রীনা। তার রোমকুপ গুলি থেকে থেকে জেগে উঠতে শুরু করে। সব শুনে আকাশ বলে
- দেখুন ঝুঁকি নেওয়া উচিৎ, কিন্তু বিপদ সবার জন্যই ভয়ংকর, বলবো না ভুল করেছেন । কারন এখান থেকে যে শিক্ষা আপনি অর্জন করেছেন তা অমুল্য। ভবিষ্যতে এরকম পদক্ষেপ কম নিলে ভালো হয়।
মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনল রীনা। তারপর নিচু গলায় প্রশ্ন করে উঠলো
- আপনি এতো রাতে আপনি কি করছিলেন?
- ও... আমি? আমার Sleeplessness আছে। রাতে ঘুম আসে না। আমার বাড়ি পাশেই। তাই মাঝে মাঝে স্টেশনে বসে তারা গুনি।
এই বলতে বলতে চেকপোস্ট পৌছে গেল। রীনাকে চেকপোস্ট ঢুকিয়ে দিয়ে । পুলিশের কাছে অনুমুতি নিয়ে বেড়িয়ে এলো আকাশ। রীনা চেকপোস্টের জানলা দিয়ে দেখতে পেল আকাশ চলে যাচ্ছে। রীনা মনে মনে বলল, ইশশ... বাই টা বলা হল না। ঠিক তখনই আকাশ পিছন না ফিরেই বিদায় নেওয়ার ইঙ্গিত জানিয়ে হাত দুটো পকেটে রেখে স্ট্রিটলাইটের আলোয় পা বাড়াল...
এই গল্পে রীনার মতই আমরাও কিছু অহেতুক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। একটা ভালো জীবনের অজুহাতে। কিন্তু এটা বুঝি না যদি জীবনটাই না থাকে। এখানে স্টেশনের মতোই একা আমরা এই জীবনে কখন তারা গোনার মতই নিজের সুখ খুঁজে নি। ঠিক সুখের পিছনেই দাঁড়িয়ে থাকে বিপদে চক্রব্যুহ। সেখানে ঐ চাওয়ালার মত কিছু মানুষ বিপদ উপভোগ করে। একসময় কেটে পরে। আবার আকাশের মত কিছু মানুষ অজান্তেই আপনার সাহায্য করতে ছুটে আসে।বন্ধু না হয়েও যেন বন্ধুর মত
“ Cherophobia ” বা কেরোফোবিয়া এমন এক সাইকোলজিকাল রোগ যাতে মানুষ খুশি হতে ভয় পায়, অর্থাৎ তার মনে এমন একটা বিশ্বাস জন্মায় যে আজ যদি আমি খুশি হই তাহলে কালকে কোনো না কোনো দুঃখ অপেক্ষা করছে, অদ্ভুত হলেও সত্যি যে পৃথিবীর ৭০% মানুষ কোনো না কোনো ভাবে এই রোগের স্বীকার। আজকের এই ছোট্ট গল্পটি হয়তো একটি মেয়েকে কেরোফোবিয়া থেকে বাঁচানোর গল্প, মানুষের স্বাভাবিক ভাবনা চিন্তা থেকে বেড়িয়ে এসে কাউকে সাহায্য করার গল্প। এক শাশ্বত জীবনের গল্প😇
Comments
Post a Comment