“বাবা”


                                                                         “বাবা”
                                                        - Dip Saha Chowdhury ( #রোদ্দুর )

কথায় বলে, একজন নারীকে যদি তুমি স্পার্ম দাও তিনি তোমায় সন্তান দেবে, তুমি যদি তাকে ঘর দাও তিনি তোমায় সংসার দেবে, যদি ভালোবাসা দাও তবে তোমায় পৃথিবী দেবে, তুমি যদি তাকে দুঃখ দাও তবে সে তোমায় নরক ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু একজন পুরুষ সে কি কিছুই ফিরিয়ে দেন না?? একজন পুরুষ তখনই পরিপূর্ন হন যখন তিনি বাবা হন। কিন্তু আমার মতে এক বাবা তখনই পরিপূর্নতা পান যখন তিনি এক কন্যাসন্তানের পিতা হন। একজন রাজকন্যাকে বড় করার দায়িত্ব যখন পান।। আজকের গল্প সম্বন্ধে একথা বলতে পারি যে গল্পটি যথেষ্ট আবেগময়, গল্পটি দুটো ভাগে বিভক্ত, দুটো ভাগ যারা পরিস্থিতির সুতোয় বাধা, মধ্যবিত্তের শ্রেনিতে বাধা। লেখার আগে এটুকুই বলার “বাবা, তোমায় খুব ভালোবাসি”।
অধ্যায় - ১
|| পর্না ||
ঢাকুরিয়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পর্না, পর্না দত্ত, ছোটোবেলায় মাকে হারিয়েছে পর্না, সুতরাং জেদি , একগুয়ে, আব্দারি। চলতি কথায় “Papa’s Princess”। ছোটবেলা থেকেই আবদার মেটাতে মেটাতে বাবা আকাশ দত্তের স্বাস ওঠার জোগার। তাও কখনো মেয়েকে বঞ্ছিত করেন নি। কারন সারা পৃথিবী এক দিকে পর্না একদিকে। মা হারা মেয়েটাকে সে কখনই চোখের আড়াল করেন না তিনি।।
তখন চৈত্রমাসের বিকেল। হনহন করে বাড়িতে ঢুকল পর্না, সামনেই দেখল বাবা বসে পেপার পড়ছেন। আদো আদো গলায় বলল,
- বাবা একটা স্কুটি কিনবো। ৩০,০০০ এ ডাউনপেমেন্ট,
আকাশবাবু বললেন,
- হবে না। সামনে বিয়েতে অনেক খরচ
- অনেক খরচ জানি, তবুও দাও না
- বকবক করিস না হবে না,
- থাক। তোমায় দিতে হবে না। তাছাড়া অর্নবদের বাড়ি থেকে তো আর পন চায় নি... তাও দিতে পারবে না??
- না... পারবো না...
শপিং ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে পর্না দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো, খাটে শুয়ে রাগে গজগজ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানে না, যখন ঘুম ভাঙল তখন দরজার ওপাশ থেকে শুনলো কারো সাথে কথা বলছে তার বাবা, আপছা আপছা শব্দে শুনতে পেল “ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না... ব্যাবস্থা হয়ে গেছে্‌...”। ফোনটা রেখেই দরজায় টোকা দিলো আকাশবাবু, “মা, খেতে আয়... আজ তোর পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করেছি...”।
পর্না ভাবল তার মানে বাবা রাজি হয়ে গেছে, সে হাসি মুখ নিয়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল পর্না।
পর্না বাবার হাতের বিরিয়ানি খতে ভালোবাসে কিন্ত আজ যেন সেটা আরো অনেক বেশি পছন্দের হয়ে গেছে... শেষ কামড়টা মুখে নিয়ে পর্না বলল,
- বাবা, কালকে টাকাটা দেবে তো ?
- কিসের টাকা?
- কেনো?? স্কুটি?
- বলেছি না, হবে না...
রাগে মাথা গরম হয়ে যায় পর্নার... ঘরে গিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করে দেয় সে...
রাত ১২ টা, পর্নার দরজায় কান রাখলেন আকাশ বাবু, কোনো শব্দ শুনতে পেলেন না। বুঝলেন তার মেয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে... সেই ছোটোবেলায় তার হাত ধরেই প্রথম হাটতে শিখেছিল মেয়েটা , পরের সপ্তাহে সেই মেয়েটি নাকি বিয়ে করবে। সংসার হবে। ছেলে মেয়ের মা হবে। কিন্তু পাগলিটা এখনো আব্দারি রয়ে গেল। কি করবে কে জানে বিয়ের পর?? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আকাশবাবু। পাখির ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর হয়ে এসেছে আগেরদিন রাতে ঐ দরজার কাছেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট বানাতে গেলেন। ব্রেকফাস্ট রেডি করে পর্নার দরজায় টোকা মারলেন তিনি,
- পর্না, ওঠ
উত্তর এলো না, আবার বললেন,
- পর্না ওঠ, ব্রেকফাস্ট রেডি,
নিস্তব্ধতা ফিরে এলো, বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো আকাশ দত্তের,
কণ্ঠস্বরে নেমে এলো উৎকণ্ঠা, চেঁচিয়ে তিনি দরজায় ধাক্কা দিলেন। তার আওয়াজে যখন সবাই ছুটে এসে দরজা ভাঙা হল ততক্ষণে সব শেষ। বিছানার পাশে পর্নার দেহটা পরে আছে , পাশে তিনটে Diazepam এর খালি পাতা পরে আছে। এই আবস্থায় আকাশবাবুর বর্ননা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আদৌ কোনোদিন হবে কিনা আমার জানা নেই ।
অধ্যায় – ২
|| আকাশ ||
“ প্রতিটা মেয়ে হয়ত তার স্বামীর কাছে রানী হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু প্রতিটা মেয়েই তার বাবার কাছে রাজকন্যা হয়ে থাকে ”
-হুমায়ূন আহমেদ
সকাল ১১ টা, ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো, ফোনটা রিসিভ করলেন আকাশবাবু, ওপাশে যে মানুষটি ধরে আছেন তিনি পর্নার হবু শ্বশুর, তিনি আকাশবাবুকে যা বললেন তা হল তিনি কিছুই নেবেন না, শুধু তাদের ছেলে একটা ব্যাবসা করবে তাই ছেলেকে ২ লাখ টাকা দিতে হবে। কথা শুনে প্রথমে মেনে নিতে পারেন নি আকাশবাবু কিন্তু পরিবার ভালো, সুতরাং একটু মেনে নিতে হবে। পর্না এখন বাড়ি নেই, সেই সুযোগে এক দালালকে ফোন করলেন আকাশবাবু, বললেন পার্ক সার্কাসে যে জমিটা তার প্রিয় সেটার জন্য খরিদ্দার খুঁজতে, মনের মধ্যে তখন কষ্টের ঝড় উঠছে, নিজেকে শান্ত করার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে মেয়ের জন্য বিরিয়ানি বানানো শুরু করলেন আকাশবাবু,
ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে গেছে কাজ সেরে পেপারে মুখ গুজলেন আকাশবাবু ঠিক তখনই হনহন করে ঘরে ঢুকল পর্না। কিছু বলার আগেই তার আব্দার শুরু , স্কুটি কিনে দিতে হবে, “৩০,০০০” ডাউনপেমেন্ট, কিন্তু এ আব্দার রাখা সম্ভব নয় তার পক্ষে, কারন এখন স্কুটি কেনা মানে, তার বিয়েতে অর্থ অনটনে পরার সম্ভবনা আছে। কিন্তু জেদি মেয়ে কিছু না বুঝেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো,
ফোনটা বেজে উঠলো, সেই পর্নার শ্বশুরবাড়ি থেকে, তারা জানতে চায় যে টাকার ব্যাবস্থা হল নাকি, তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন। মেয়ের রাগ হয়েছে। কিন্তু রাগ ভাঙ্গানোর অস্ত্র তার জানা আছে, “বিরিয়ানি”। বিরিয়ানির শেষ কামড়েও তার আব্দার মেটেনি ... এরপরের গল্প সবারই জানা...
রাত ৮টা,
পুলিশি কাজকর্ম সেরে যখন বাড়ি ফিরলেন আকাশবাবু তখন বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল হারানোর গল্পকে প্রতিধ্বনিত করছে, নিস্তব্ধতা তখন ফিস্ ফিস করে যেন বিদ্রুপ করছে , বলছে আকাশ তুমি হেরে গেছো, তুমি ব্যর্থ , তুমি পাপী। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি মেঝেতেই বসে কাঁদতে লাগলেন, কিন্তু সে কান্না শোনার কেঊ নেই। একটু পরে জীবনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, গেলাসে একটু জল ঢেলে গলা ভেজালেন। তারপর অন্ধকারের মধ্যে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন নিজের ঘরে।
সকাল ছটা,
দত্ত বাড়ির সামনে আবার ভিড় জমেছে, আজ সকালে রথীনবাবু তার প্রিয় বন্ধুটিকে সান্ত্বনা দিতে এসে দেখেন পাখার সাথে ঝুলছে আকাশ দত্তের দেহটা ... নিচে একটা চিঠি। সেই চিঠিটাই এখানে তুলে দিলাম,
অপ্রিয় জীবন,
ছোটোবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিলাম কিছু রাতের কখনই ভোর হয় না। ভাবিনি কখনো আমার জীবনটাই তার উদাহরন হবে, আমিও চির ভাগ্যহীনদের মিছিলে পা মেলাবো তা ভাবিনি। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। মা আমায় নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু যখন আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম ততদিনে মা চোখ বুঝেছেন ,
খুব ভালোবেছিলাম সুমিতাকে। জীবনের সব সুখ বেঁধে দিতে চেয়েছিলাম তার ঐ আঁচলে, যখন ও প্রেগন্যান্ট হল সেদিন ছিলো আমার সবচাইতে খুশির দিন, ও বলেছিল তোমার কি চাই?? আমি বলেছিলাম একটা রাজকন্যা যার চোখদুটো তোমার মতো হবে, ও বলেছিল আর তোমার মতো হাসিটা পাবে। আমি ওর পেটে মাথা রেখে কান পাততাম , বলতাম কি প্রিন্সেস কেমন আছে , ও লাথি মেরে উত্তর দিত, সেই যেদিন পর্না হল ভগবান আমার কাছ থেকে সুমিতাকে কেঁড়ে নিলো, তাও বাঁচার একটু আলো দিয়েছিলো “পর্না” নামে। ও যখন জেদ ধরত তখন ওর মধ্যে সুমিতাকে খুঁজে পেতাম । আজও মনে পরে ওর প্রথম স্কুল যাওয়া, শাড়ি পড়া, খেলনা ভেঙ্গে যাওয়ার কান্নাকাটি... সব সব, ওর বিয়ে দিয়ে আমি বাবার দায়িত্বটা পুরন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবন... হায় তুমি সেই সুযোগ ও দিলে না, বারে বারে প্রমান করে দিলে , আমি একজন ব্যর্থ ছেলে, স্বামী, বাবা । তাই আজ তোমার জেদের কাছে আমি হেরে গেলাম। আর কোনো উপায় নেই, একজন পঙ্গু সৈনিক আমি। বাতিলের খাতায় নিজের নাম লেখালাম, স্বপ্ন দেখার সবাইকে মানায় না, ঐসব স্বপ্নপ্রেমিকদের পৃথিবী ছাড়তে হয়। তাই ডারউইনের সুত্র মেনে তাই আমি বিলুপ্ত হলাম। অন্য সৈনিকদের নিয়ে তুমি এই হারার খেলা চালিয়ে যাও... শুধু একটা কথাই বলার একদিন মানুষ তোমায় ঘৃনা করবে জীবন... মৃত্যুকে মহান করে তুলবে। আমার মিছিলে একদিন জনস্রোত নামবে। সেইদিন নিজেকে সামলে রেখ জীবন , কাঠগড়া সেদিন তোমার কান ঝালাপালা করে দেবে। স্বপ্নহারা মানুষগুলো আঙ্গুল তুলবে তোমার দিকে, পারবে তো সেদিন নিজেকে মহান বলে ডাকতে।
ইতি -
এক সর্বহারা সৈনিক। এক হেরে যাওয়া বাবা

Comments

Popular posts from this blog

ফিউসবক্স (Sequel of কলেজস্ট্রিট)

“ওম”

♥ ♥ ব্যারিকেড ♥ ♥