শেষ ডাইরির পাতা থেকে
শেষ ডাইরির পাতা থেকে
-
রোদ্দুর(দীপ সাহা
চৌধুরী)
28/02/2017, মঙ্গলবার,
একটি বেসরকারি
হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে ডাইরিটা লিখছি। ডাইরিটার আগের পাতাগুলি ফাঁকা দেখে অবাক
হচ্ছেন?? ভাবছেন হঠাত কোথা থেকে টপকে পড়লাম? আসলে এর আগে লেখার দরকার পরেনি। তাই
পাতাগুলিও কালির ছোঁয়া পায়নি। আজকে যদি এই সবুজ লাল বাতি ঘেরা এই ঘর আর যান্ত্রিক
শব্দগুলি যদি না শুনতাম তাহলে হয়তো আজও এই পাতাটা সাদা হয়য়েই থাকতো। কালির গন্ধ
পেত না। জানেন মানুষের জীবনের শেষ মুহুর্তে মানুষের আফসোস খুব সেই জিনিসে হয়না যে
জিনিস আপনি হারিয়েছেন। বরং সেই জিনিসে হয় যেটা আপনি পাননি। আজ আমার আফসোসটাও ঠিক
তাই নিয়ে। তার আগে কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করা দরকার মানে, ...... কীভাবে এটা হল ...
এইসব আরকি... ধরে নিন একটা রচনার ভুমিকা।
৩ মাস হয় চাকরিটা
পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গে চাকরি পাওয়াটা আমাদের মত সাধারন ছাত্রদের পক্ষে কতটা কঠিন
সেটা না হয় ব্যাখ্যা না করলেও উপলব্ধি করতে পারবেন বোধ হয়। তো এই তিনমাস বেলা বোস
আর আমার হেডফোনে বাজেন না। কোম্পানি বলেছিল তিন মাসের কোন স্যালারি হবে না। তিন
মাস পর চাকরি পাকা হবে এই তিন মাস নাম মাত্র মায়না পাবে। রাজি হয়েছিলাম । কারন আমি
এই কয়দিনে এটা বুঝেছি যে কোম্পানি আমায় জামাই আদর করবে না। তো তিনমাসের আশায় মনের
চাষাটাকে পালন করেছিলাম। আর জীবনে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে তার হাতটা যখন ধরতেই
হবে তখন যোগ্য হয়েই ধরব । যাতে থেমে যেতে না হয় ছেড়ে যেতে না হয়। এই কয়দিন খুব
খেটেছি। যাতে পার্মানেন্ট হতে পারি। শুধু একটাই আশা যদি চাকরিটাতে পার্মানেন্ট হতে
পারি সেটা অনেক বড় পাওনা হতে চলেছে । প্রথমত, অর্থ দ্বিতীয়ত, সঙ্গী। আমি বিশ্বাস করি যে টাকা দিয়ে
ভালবাসা হয়না কিন্তু টাকা ছাড়া ভালোবাসা বাঁচে না। তাছাড়া পরিবারের দায়িত্বও একটা
বড় ব্যাপার। তাছাড়া যে মানুষটি আসবে সে আমার সম্পত্তি নয় । আমার রাজকন্যে, আমার
রানি। সুতারাং বেকারত্বের পৃথিবীতে রানি বেমানান। তো কাল সকাল থেকে মনটা খুশি ছিল
। কারন আর যাই হোক আজ থেকে আমি চাকুরিজীবি ।। পার্মানেন্ট ... সারাদিন কাজ করে
ফিরছিলাম। ভাবলাম আজ বিরিয়ানি নিয়ে যাবো... বিশ্বাস করুন বিরিয়ানি আমার খুব কাছের
... তাই আজ ওকে ভুললে মীরজাফরও হয়তো বিশ্বাস ঘাতকের তকমা লাগিয়ে দেবে। এই ভেবে
সেকটার ফাইভের থেকে বাস ধরলাম। বিধানণগরে নামবো। অনেকদিন তাকে ফোন করা হয়নি এই
ভেবে ফোনটা বের করলাম । এখনো প্রায়োরিটি লিস্টে জলজ্বল করছে ওর নামটা । বাসে উঠে কল
করতেই দেখলাম কল কেটে গেলো। দেখলাম নো নেটওয়ার্ক। উফফ... সুখবরগুলি দেওয়ার সময় যেন
মামারা নেটওয়ার্কের খেলা দেখায় ।। যেন পি.সি. সরকারের ম্যাজিক হচ্ছে। এই ছিল বেড়াল
হয়ে গেল রুমাল। তো অগত্যা কি আর করার হেডফোনটা কানে গুঁজে গান চালালাম ... অনুপমদার
গানগুলি । গান শুনতে শুনতে জানলার ধারে বসন্তের হাওায়ায় কখন যে ঘুম ভাবটা এল জানি
না হঠাত, ফোনটা কেঁপে উঠলো। কোম্পানির ম্যাসেজ ।। মানে নেটওয়ার্ক এসেছে। ফোনটা
মুহূর্তের মধ্যে যেন নিজের থেকেই ইঙ্গিত দিল ফোন করার। ফোনটা করতেই ওপাশ থেকে একটি
যান্ত্রিক কণ্ঠ জানিয়ে দিল যে ফোন নেটওয়ার্কের বাইরে। আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল,
ফোনটা কাটতেই গানটা আবার চালু হল। সবে গানটায় মন দিয়েছি হঠাত একটা ঝাকুনি।। নিজের
তলপেটের কাছে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম । আর কিছু মনে নেই।
৩০-৪০ মিনিট হবে
জ্ঞান ফিরেছে । দেখলাম একজন ডক্টর এসে চেকাপ করলেন । এবং নার্সকে কিছু একটা ইঙ্গিত
করলেন। নার্স চলে যেতেই ডক্টর বললেন-
-
চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে
যাবেন।
কিন্তু ছোটবেলা থেকে সাইকোলজিটা একটু বুঝি।
ওনার মুখের ভাবের সাথে কথার ঠিক যোগসূত্র খুঁজে পেলাম না। সুতারাং, কাকুতি মিনতি
করলাম। উনিও বলার পাত্র নন আর আমিও ছাড়বার নই ।। এদিকে তলপেটের ব্যাথাটা বাড়ছে।।
শেষে কেঁদে ফেলতেই উনি স্বীকার করতে রীতিমত বাধ্য হলেন। যা বলেন তা অনেকটা এই রকম।
“আমি যে বাসটাতে বাড়ি ফিরছিলাম তার সাথে একটি লরির
সংঘর্ষ হয়। তাতে সামনের সিটের ব্যাক্তি খুব আঘাত পান ও তার বোতলের একটি কোনা
বেকায়দা ভাবে আমার তলপেটে আঘাত করে এবং তাতে আমার লিভারের ৮৫% ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এবং
প্যাঙ্ক্রিয়াস এর অর্ধেকটা। এবং এতে আমি পৃথিবীর ক্ষণিকের অতিথি নির্বাচিত হয়েছি।
আমার RBC কাউন্টিং ক্ষণে ক্ষণে কমছে
... কারন লিভারটা অকেজো।”
আমি ডাক্তারকে বললাম-
-
স্যার ৩ টে ইচ্ছে পুরন
করবেন?
-
বলো,
-
একটা ডাইরি, একটা
মরনত্বরের অঙ্গদানের কাগজ আর একটা হাই ডোজের পেইঙ্কিলার দেবেন? আমি আমার চোখ ,
কিডনি আর পারলে হার্টটা দিয়ে যেতে চাই। আর স্যার জীবনে অনেক অনেক অনেক ব্যাথা
পেয়েছি অন্তত মৃত্যুটা বেদনাহীন হোক!
ডাক্তারবাবু সম্মতি দিয়েছিলেন। হয়তো তাই আজ
লেখটা জানাতে পাড়ছি। সত্যি না হতে পারলাম একজন ভালো ছেলে ।। না ভালো স্বামী। না
ভালো বাবা। বলে না... সব ফুলই জন্মায় ঠাকুরের চরণস্পর্শের জন্য কিন্তু কটা ফুল টা
করতে পারে??
আমার জীবনটাও ঠিক তাই... ভালোবাসার জন্য অনেক
প্রেমিকের জন্ম হয় কিন্তু তাদের জীবনে বসন্তে মুকুল ধরে না... হয়তো এখানেই গল্প
শেষ। হাতটা কাঁপছে। চোখ জুড়ে অন্ধকার নামছে। আয় না ভালোবাসা ঘুম হয়ে আয় নেমে... ।
মা এ জন্মে তোমার কথাগুলো রাখতে পারলাম না। কিন্তু পর জন্মে আমার মা হয়েই থেকো... এখনো মনে
পড়ছে হেডফোনে শোনা শেষ কটা লাইনঃ “যদি কোনোদিন তুমি দু হাত দিয়ে ঝিনুক কোড়াও নেই আমি সেই অল্প ভাঙা গল্পগুলোয়……… ”
Comments
Post a Comment