|| ফিরে চলার গল্প ||



দীপেশের শেষকৃত্যের আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। মৃত্যু কারো একদিনে আসে না। ধীরে ধীরে আসে ক্ষণে ক্ষণে আসে। আর তার সাক্ষী আমি । তার আগে বলে রাখি আমি একজন ডাক্তার। কলকাতার এক স্বনামধন্য হাসপাতালে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর প্র্যাকটিস করছি। সেখানেই ভর্তি ছিল দীপেশ । বছর বাইশের ছেলেটা। যখন ভর্তি হল তখন সব প্রায় শেষ । তবুও চেষ্টা করে দেখা আমার কর্তব্য তাই বিভিন্ন পরীক্ষা দিলাম। তাতে পরেরদিন ধরা পড়ল ছেলেটির tuberculosis আছে। এবং সেটা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে বলতে গেলে বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু এই অবস্থা থেকেও এর আগে আমি রুগীকে ফিরিয়ে এনেছি। তো সেই মতো মেডিসিন দিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের কথা... কাজ হল না। এর আগে এমনটা হয়নি। রুগী কিছু হলেও সুস্থ বোধ করেছে । কিন্তু এবার সেটা হল না।
তো ঠিকই করলাম ছেলেটির সাথে আলাদা করে কথা বলব। সেই মতো নার্সকে বললাম ব্যাবস্থা করতে । সেইদিন রাতে ছেলেটি এলো। কেবিনে । চোখের তলায় কালি পড়েছে । মৃত্যুর সমস্ত দাগগুলি ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে। আমি তাকিয়ে থাকতে পারলাম না । প্রশ্ন করলাম-
- নাম কি?
- দীপেশ
- পুরো নাম?
- দীপেশ চৌধুরী
- বয়েস
- বাইশ
- জানো তোমার কি হয়েছে?
- হুম, টিবি, এও জানি সময় শেষ
- আরে এরকম কিছু না।
সামান্য একটু কেশে সে বলল
- জোসেফ মারফির নাম নিশ্চয়ই জানা আছে।
জোসেফ মারফিকে আমি জানি। বিশ্ববিখ্যাত সাইকোলগিস্ট। তাই বললাম
- চিনি
- উনি একবার বলেছিলেন। “ যদি আপনি নিজের মন থেকে সুস্থ হতে না পারেন তবে কোনদিন মেডিসিন আপনাকে সুস্থ করতে পারবে না। আপনার অবচেতন মন আপনাকে জন্ম দিয়েছে , বড় করেছে, তাই সেই আপনাকে সুস্থ করতে পারে সবার আগে“
ভালই বুঝতে পারলাম যে কেন আমার ওষুধ কাজ করছে না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সেই প্রশ্নটা করল
- আপনার কি লাভ ম্যারেজ?
আমি সাধারনত নিজের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে কাউকে কৈফয়েত দিই না। তবুও কেন জানি না ছেলেটার কথায় কোন সঙ্কোচ ছাড়াই বেড়িয়ে এলো
- হ্যাঁ
- তাহলে আপনি আমার আবস্থাটা বুঝবেন, আমি একটা মেয়েকে খুবই ভালবাসতাম। বলতে পারেন জীবনের সব কিছু দিয়ে ভালবাসতাম। সে কোনদিনই মেনে নেয় নি। তাতে আমার কোন আপত্তি ছিল না। আমি চির অপেক্ষাতেও রাজি ছিলাম। ওই যে বললাম সব কিছু যে দিয়ে দিয়েছি। তাই ফেরার উপায় ছিল না, একদিন বিকালে আমাদের মাঠের পাশ দিয়ে ফিরছি। দেখতে পেলাম দুটি মূর্তি পাশাপাশি পিছন ফিরে বসে আছে। দেখে মনে সত্যি ভাল লেগেছিল , ভেবেছিলাম এমন দিন আমারও আসবে। ঠিক যেমন ওই মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে ঠিক তেমনিই আমরাও থাকবো। ওই একটা কথা আছে না “চাও... একদিন নিশ্চয়ই পাবে ”। তাই আমিও অপেক্ষায় রাজি । এই ভেবে পিছনে ফিরতে যাব এমন সময় হাসিটা কানে এলো।। চেনা হাসি আর ছেলেটার গলার আওয়াজও চেনা। হঠাৎ দুজনের জামার দিকে চোখ পড়ল। দুটো জামাই আমার চেনা, পাসের মেয়েটিকে আমি চিনি, আর ছেলেটি আমারই খুব কাছের বন্ধু।
ছেলেটির চোখের কোনা ভিজে এলো। ছেলেটি বলতে লাগলো।
- আমার যেন বুকের ভেতরটা ফেটে এলো। কোনরকম চোখ নামিয়ে ফিরতে গিয়ে একটা পাথরে হোঁচট খেতেই একটা শব্দ হল তাতে দুজনেই পিছন ফিরল ততোক্ষণে আমি প্রাণপণে দৌড়ে চলেছি।
পিছন থেকে সুর ভেসে এলো – “ দীপ তুই যা ভাবছিস তা নয় ”
কিন্তু তাতে আমার কান দেওয়ার ইচ্ছা নেই। নিজের উপর ঘৃণা জন্মেছে। এরপর অনেক ম্যাসেজ এসেছে আমি খুলেও দেখিনি। দেখতেও চাই না।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম-
- মেয়েটা তো তোমাকে বলে নি যে সে আর কাউকে ভালোবাসে না।
- বলেছিল । এমন ভাবিস না যে আমি কারো জন্য তোকে রিজেক্ট করছি। আর ছেলেটা আমাকে বলেছিল চিন্তা করিস না আমি হেল্প করবো। হেল্প... হেল্প...
বলে ছেলেটি চলে গেলো। আমি ভাবলাম পরেরদিন ছেলেটাকে একটু বুঝাব। কিন্তু পরের দিনটাই যে এলো না... রাত তখন ৪টে ফোন এলো বেড নং ১৪৩ আর নেই স্যার। এভাবেই শেষ হল এক হারিয়ে যাওয়া তরুণের গল্পও... এক ফিরে চলার গল্প
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল । খেয়াল হল আমি একজনের জীবনের শেষ আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে... ফোনটা ধরে শুনতে পেলাম
- স্যার... একজন রুগী এসেছেন।। যদি একবার এমারজেন্সিতে আসেন
- আসছি।
বিঃ দ্রঃ “এই গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ঘটনা মাত্র। ”

Comments

Popular posts from this blog

ফিউসবক্স (Sequel of কলেজস্ট্রিট)

“ওম”

♥ ♥ ব্যারিকেড ♥ ♥