মায়ার মুকুট


১৪ই জুলাই ,২০১৬ - একটা জোর শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল । ধড়মড়িয়ে উঠে দেখলাম সেরকম কিছুই না ট্রেনের হর্নটা বেজে উঠেছে । আসলে কালকের ঘটনাটা আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে এখন উৎকণ্ঠাতে আমার সময়গুলি নিজেকে নাগপাশে জড়িয়ে ফেলেছে । ছোটবেলা থেকে আত্মা, ভূত এদের গল্প পড়তে খুব ভালোবাসি। আসলে মানুষের আদিমতম রহস্যকে কে না উদঘাটন করতে চায় । Edger Allen Poe, Bram Stoker, Shirshendu Mukherjee বা Alfred Hitchcock এরা সবাই আমার খুব কাছের । কতোমানুষ যে এই রহস্য উদ্ধারে গিয়ে এই রহস্যের অন্ধকার গুহায় নিজেকে বন্দি করেছে তার শেষ নেই। এই সবই ভাবছি এমন সময় সামান্য বৃষ্টির ছাঁট এসে আমাকে বাস্তবের মাটিতে আবার আছড়ে ফেলল। দেখলাম পাশে এক ভদ্রলোক বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছেন । হঠাৎ কি মনে হতেই তিনি বলে উঠলেন সবই মায়া. . আর এই মায়া শব্দটা শুনতেই আমার ভিতরে আবার একটা যুদ্ধ শুরু হল। আমি কুঞ্জন চৌধুরি বি.এস.সি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি আর আমার এক বন্ধু অর্ণব এসেছিলাম মুকুট মনিপুর। বাঁকুড়া থেকে ৫৫ কিমি দূরে কংসাবতি নদীর ধারে গড়ে ওঠা এই ছোট্ট মফঃস্বলটি সত্যি যেন অপার সুন্দর এক নীরব রুপকথার সাক্ষী। সেখানে অর্ণবের এক মাসির বাড়ি তো সেখানে থেকেই জায়গাটা ঘুরবো ঠিক হল। একদিন দুপুরে ভাত খেয়ে আর ঘুম না আসায় ঠিক করলাম যে আজকে একটু উত্তরের দিকে যাবো। অর্ণব বলেছিল ঐদিকে একটা পুড়ানো রাজবাড়ি আছে তবে সেখানে নাকি মানুষের যাতায়াত নেই। ভূতুড়ে বলে বাড়িটার একটু কুখ্যাতি আছে। ঠিক করলাম যে বাড়িটা দেখেই আসি। যা বলা তাই কাজ, আমি আর অর্ণব বেড়িয়ে পড়লাম। ওর মাসি বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। বাড়িটার অনেকটা অংশই ভেঙে পড়েছে। এখানে ওখানে শ্যাওলা জমেছে। একটু এগিয়ে যেতেই একটা সিঁড়ি চোখে পড়ল সেটা বেয়েই আমরা দুজন উপরে উঠলাম। দেখলাম এখানে কতগুলি ঘর আছে। অর্ণবকে বললাম তুই বাকিগুলি দেখ। আমি এখ নেই আছি। তো সে এগিয়ে চলল আমি একটা ঘরে ঢুকলাম। এই ঘরটা একটু আলাদা মনে হল। তবে কেন মনে হল সেটা বোঝাতে পারবো না। দেখলাম ঘরটার এককোণে একটা চেয়ার এর মত কিছু একটা আছে। সেটাতে গিয়ে বসলাম। চেয়ারটাতে বসতেই কেরকম একটা অস্থিরভাব আসতে শুরু করল। কিছুক্ষন পর দেখলাম যে সব কেমন যেন অন্ধকারে ডুবে যেতে শুরু করল। একটু পরে দেখলাম পুরো ঘরটা কেমন বদলে গেছে। ঘরটা যেন নিজে থেকেই সেজে উঠলো মাথার উপর ঝারবাতি জ্বলছে। দেয়ালগুলো যেন নতুন রঙ করা হয়েছে। একটু নিচের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একজন নারী আমার পায়ের কাছে পরে আছে। আর আমার হাত ঐ চেয়ারের সাথে বাঁধা। আর পাশের ঘরে কারা যেন হইহট্টগল করছে। একটু পরে তারা এই ঘরেও ছলে এলো, কালো কাপড়ে তাদের মুখ ঢাকা। এসে তারা জিজ্ঞাসা করল “বল বাড়ির সিন্দুকটা কোথায়??” আমি নিজের থেকেই বলে উঠলাম জানি না । কিন্তু এই গলার স্বর আমার নয়। এ তো কোন মাঝবয়সি ব্যাক্তি কথা বলছে। সিন্দুকের খবর না পেয়ে ঐ কালো কাপড় পড়া একজন সামনে পরে থাকা মহিলার বুকে ছুরি বসিয়ে দিলো আর সেই মহিলা কাতরাতে কাতরাতে একসময় নীরব হয়ে গেলেন। বুঝলাম তিনি আর ইহজগতে নেই। এরপর আবার সেই প্রশ্ন “শেষবার বলছি বাড়ির সিন্দুকটা কোথায়??” আমারও একই উত্তর “জানিনা” । তারপর সেই ছুরিটা তুলে নিয়ে সেই কালো কাপড় পড়া লোকটা আমার গায়ে ছুরিটা একবারে গেঁথে দিলো। আমি ছটফট করতে লাগলাম।। এমন সময় কানের কাছে কেউ বলল “ঐ ঘুমিয়ে পরলি নাকি ওঠ!!! যেতে হবে ।” চোখ খুলে বুঝলাম স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু আমার মন বলছে এটা স্বপ্ন নয়। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে উঠে পড়লাম। একটু এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম মিত্তির দাদু আসছেন। এখানে এসে লোকটার সাথে পরিচয় হয়েছে খুব এ ভাল লোক। লোকটা আমাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “কি শহরের বাবুরা কি দেখলে ঐ রাজবাড়ি. . . কেমন??” অর্ণব বলল “ভালো গো দাদু” আমিও সুযোগ বুঝে বললাম “আচ্ছা দাদু এই বাড়িটার একটা গাল্প আছে শুনলাম...” তাতে দাদু যা বললেন তার সারাংশ অনেকটা এরকম... এই বাড়ির মালিক ছিলেন জমিদার প্রতাপ আদিত্য সেন। লোকটি ছিলেন নিঃসন্তান। কিন্তু খুব লোভী ছিলেন। মানুষ ঠকিয়ে বেশ টাকাকড়িও গুছিয়ে ছিলেন। একসময় এই গ্রামে খরা নামে।। মানুষের অর্থের টান পরে। আর যেখানে অর্থসঙ্কট সেখানেই দুষ্কর্মের সূচনা। গ্রামে ডাকাত পড়তে শুরু করল। একরাতে এই জমিদার বাড়িতে ডাকাত পড়লো। শোনা যায় যে ডাকাতরা সিন্দুকের কথা জমিদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার সিন্দুকের হদিস কোনমতেই তাদের বলেন নি। সেই ক্রোধে ডাকাতরা প্রথমে তার স্ত্রীকে ও পরে তাকে খুন করে। তার ও তার স্ত্রীর লাশ দোতালার এক ঘর থেকে উদ্ধার হয়। তাকে একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। আজও নাকি প্রতাপ সেনের আত্মা সেই সিন্দুক আর তার মধ্যে থাকা ধন-সম্পত্তির মায়া ছাডতে পারেন নি। শোনা যায় কখনকখনও রাতের বেলা দোতালার একটা ঘরে মাঝে মাঝে ঝারবতি জ্বলতে দেখা যায়। চ্যাঁচ্যাঁমিচি ও শোনা যায়। অর্ণব বলল “ সত্যি একটা জম্পেশ গল্প বটে”। কিন্তু আমি জানি এ গল্প নয় এটা সত্যি কথা। আমি পরেরদিনই রওনা দিই। অর মাসি-মেসো অনেক অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু একটা অযৌক্তিক যুক্তি দিয়ে অর্ণবকে আরও কিছুদিন ওখানে থাকার সুযোগ দিয়ে সকালের ট্রেনে শিয়ালদাহ ফিরছি। আজ অনুভব করলাম যে লোভ,মায়া কিভাবে মানুষকে শেষ করে জীবনে মরণে মৃত্যুর পরেও। । এই এক আদিম রিপুর উপাখ্যান। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে যা মানুষের ভাবনার বাইরে কিন্তু উপলব্ধির অন্তরে।। ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে।। “হ্যাঁ ।। জীবন যখন আছে এগিয়ে যেতে হবে।। মেঘ হোক বা রোদেলা দিন। জীবন বড়ই রঙিন”

Comments

Popular posts from this blog

ফিউসবক্স (Sequel of কলেজস্ট্রিট)

“ওম”

♥ ♥ ব্যারিকেড ♥ ♥